
ভারতের রপ্তানি খাত এখন এক জটিল ও সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। সাম্প্রতিক মার্কিন শুল্ক নীতির ফলে ভারতের রপ্তানি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের অনুমান অনুযায়ী, মোট রপ্তানি ৬০.২ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে আসতে পারে মাত্র ১৮.৬ বিলিয়ন ডলারে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই রপ্তানি কমতে পারে ৪৩ শতাংশ, যা ভারতের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ও রপ্তানিনির্ভর শিল্পকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলবে। এটি শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকেও নাড়িয়ে দিতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, শুল্কের প্রভাবে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২৬ অর্থবছরে ০.৪ থেকে ০.৫ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। এই প্রভাব সরাসরি পড়বে বেসরকারি বিনিয়োগে, শ্রমবাজারে এবং দেশীয় উৎপাদনে। দেশীয় বিনিয়োগকারীরা যখন অনিশ্চয়তার কারণে বড় আকারের বিনিয়োগে পিছিয়ে যাবেন, তখন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে এবং শিল্পোৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর সম্প্রতি বলেছেন যে বাণিজ্য আলোচনার দ্বার এখনও খোলা রয়েছে। তবে তিনি একইসাথে উল্লেখ করেছেন, ভারতের রাশিয়ান তেল আমদানির উপর মার্কিন চাপ চীন বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এ বক্তব্য ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানকে পরিষ্কার করে—তারা মনে করছে, মার্কিন নীতি বৈষম্যমূলক এবং ভারতের জন্য বিশেষভাবে চাপ সৃষ্টি করছে।
রয়টার্স জানিয়েছে, ভারতের তিনটি বড় তেল পরিশোধন সংস্থা নিশ্চিত করেছে যে শুল্ক সত্ত্বেও তারা রাশিয়ান তেল কেনা চালিয়ে যাবে। ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য এটি একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ, কারণ রাশিয়ান তেল তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং ভারতের শক্তি চাহিদা পূরণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বছরের শুরুতে আশা করেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনার মাধ্যমে শুল্কের মাত্রা ১৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকবে। কিন্তু সেই আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় বর্তমানে ভারতের সামনে বড় ধাক্কা নেমে এসেছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের মোট পরিমাণ এখন ১৯০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এত বড় বাণিজ্য সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ শুল্ক আরোপ এবং আলোচনার ব্যর্থতা ভারতের অর্থনীতিতে গভীর সংকট তৈরি করছে।
কেন্দ্রীয় সরকার বলেছে তারা প্রতিশোধমূলক কোনো পদক্ষেপ নেবে না, তবে ধাক্কা কমানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ কারণে শিল্পমহলের সঙ্গে একাধিক বৈঠক চলছে। এছাড়া ২৫,০০০ কোটি টাকার একটি রপ্তানি উন্নয়ন মিশন বিবেচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য অর্থায়ন, নিয়ন্ত্রক সহায়তা, ই-কমার্স হাব গড়ে তোলা, গুদামজাতকরণের উন্নতি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে “ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া”কে আরও শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করা। এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ) সংশোধনের পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য আরও নানা প্রস্তাব আলোচনাধীন রয়েছে।
ভারত সরকার জানে, শুধু তাৎক্ষণিক সমাধান নয়, দীর্ঘমেয়াদি কৌশলও প্রয়োজন। সেই জন্যই এখন জিএসটি সংস্কার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ভারতের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল স্পষ্ট করে বলেছেন, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে জাতীয় স্বার্থ সর্বাগ্রে থাকবে। শ্রমনির্ভর খাতগুলো যেমন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও টেক্সটাইলকে জিএসটি কাঠামোর মাধ্যমে সহায়তা দেওয়া যেতে পারে, যাতে দেশীয় চাহিদা বাড়ে এবং রপ্তানি ক্ষতির প্রভাব কিছুটা হলেও কমে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শ্রমবাজার। রপ্তানি হ্রাস মানেই হবে হাজার হাজার ছোট ও মাঝারি শিল্প বন্ধ হওয়া এবং লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়া। ভারতের শিল্পাঞ্চলগুলো, বিশেষ করে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ এই অঞ্চলগুলো রপ্তানিনির্ভর শিল্পের ওপর নির্ভরশীল।
একইসাথে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরাও ভারতের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা দেখতে চাইবেন, ভারত কীভাবে এই সংকট সামাল দেয়। যদি সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে এবং শিল্পকে কিছুটা হলেও সুরক্ষা দিতে পারে, তবে বিনিয়োগকারীরা আস্থা রাখতে পারেন। কিন্তু যদি শ্রমবাজারে অস্থিরতা বাড়ে, শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায় এবং বাণিজ্য আলোচনায় কোনো সমাধান না আসে, তবে দীর্ঘমেয়াদে ভারতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আন্তর্জাতিক কূটনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শুধু বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি কৌশলগত সম্পর্কও বটে। চীন ও পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা এবং আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অন্যতম সহযোগী। এই প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক স্বার্থে সম্পর্কের অবনতি ভারত বা আমেরিকার কারো জন্যই দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হবে না।
তবে বাস্তবতা হলো, আপাতত ভারতীয় রপ্তানিকারকরা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা কমে গেছে, কারণ উচ্চ শুল্ক তাদের পণ্যকে তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল করে তুলছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড কিংবা মেক্সিকোর মতো দেশগুলো এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ করতে পারে। ফলে ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে।
অর্থনীতিবিদ অজয় শ্রীবাস্তব একে ভারতের রপ্তানি-নেতৃত্বাধীন প্রবৃদ্ধির জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার মতে, আগামী কয়েক মাস ভারতের শিল্প, কর্মীশক্তি এবং কূটনীতির জন্য বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াবে। এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও এক কঠিন সময় হতে চলেছে।
সবশেষে বলা যায়, ভারতের সামনে এখন দুটি বড় পথ খোলা রয়েছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো। দ্বিতীয়ত, দেশীয় নীতি, সংস্কার ও প্রণোদনার মাধ্যমে শিল্প ও শ্রমবাজারকে সুরক্ষিত করা। ভারত সরকার ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে সেগুলো যথেষ্ট কি না তা সময়ই বলে দেবে।
ভারতের জন্য এই সংকট একইসাথে চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ। চ্যালেঞ্জ হলো, হঠাৎ করে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া। সুযোগ হলো, দেশীয় বাজারকে শক্তিশালী করে, শ্রমনির্ভর খাতকে সমর্থন দিয়ে এবং নতুন বাণিজ্যিক অংশীদার খুঁজে বের করে অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করা। আগামী কয়েক মাসে ভারত কীভাবে এই সংকট সামাল দেয়, তার ওপরই নির্ভর করবে দেশের দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা।
আপনার মতামত জানানঃ