বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাদ্রাসা একটি বৃহৎ অংশ হলেও কর্মসংস্থান খাতে এ ধারার শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সীমিত। প্রতি বছর কওমি ও আলিয়া ধারার মাদ্রাসা থেকে প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করলেও এদের একটি বৃহৎ অংশ প্রাতিষ্ঠানিক চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকেন। আধুনিক কারিগরি ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার সঙ্গে মাদ্রাসাগুলোর সংযোগ কম থাকায় শ্রমবাজারে মাদ্রাসা গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা নিয়ে নেতিবাচক ধারণা গড়ে উঠেছে। ফলে তারা চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এবং অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন স্বল্প আয়ের শিক্ষকতা বা ক্ষুদ্র ব্যবসার দিকে ঝুঁকতে।
বেকারত্বের এই বাস্তবতা স্পষ্ট হয়েছে আল-আমিন ও আবদুল্লাহর অভিজ্ঞতায়। একজন ফাজিল ডিগ্রি সম্পন্ন করে চাকরির সুযোগ না পেয়ে কৃষিপণ্যের ব্যবসা করছেন, আরেকজন দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করে মাদ্রাসা শিক্ষকতার পরে প্রিন্টিং ব্যবসায় জড়িয়েছেন। এটি বোঝায় যে, শিক্ষা থাকলেও সে অনুযায়ী চাকরি নেই। এমন বাস্তবতায় যারা বেঁচে থাকতে চান, তাদের জন্য পথ হলো আত্মকর্মসংস্থান কিংবা অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ খোঁজা। অথচ দেশের অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা থাকলে এই বিশাল জনগোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক খাতে অবদান রাখতে পারত।
সরকারি তথ্য মতে, ২০২৩ সালে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ লাখে। এর বড় অংশই মাদ্রাসা শিক্ষিত। ব্র্যাক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৪.৩৮ শতাংশ মাদ্রাসা শিক্ষার্থী প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিতে নিয়োজিত। কওমি ধারায় এ হার আরো কম—মাত্র ২.১৭ শতাংশ। অধিকাংশই ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিন বা মাদ্রাসা শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন, যেখানে বেতন অনিয়মিত ও কম। সিলেট, কক্সবাজার কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো বিভিন্ন জেলার অভিজ্ঞতাও একই রকম।
কারণ হিসেবে উঠে এসেছে যুগোপযোগী কারিকুলামের অভাব, তথ্যপ্রযুক্তিতে দুর্বলতা, সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কওমি শিক্ষার কিছু স্তরের সরকারি স্বীকৃতি না থাকা। কওমি ধারার শিক্ষায় ‘দাওরায়ে হাদিস’ স্তরটি মাস্টার্স সমতুল্য স্বীকৃতি পেলেও আগের স্তরগুলো স্বীকৃত নয়, ফলে চাকরির আবেদনে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এমনকি সিজিপিএ ভিত্তিক আবেদন প্রক্রিয়ায় কওমি শিক্ষার্থীরা আবেদনই করতে পারেন না। ফলে তারা চাকরির বাইরে থেকে যান এবং নিজস্ব উদ্যোগে ব্যবসা কিংবা বিদেশে উচ্চশিক্ষার দিকে ঝুঁকেন।
এই প্রেক্ষাপটে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন জরুরি হয়ে উঠেছে। অনেকেই বলছেন, দক্ষতা থাকলেও চাকরিদাতারা এখনো মাদ্রাসা শিক্ষাকে সন্দেহের চোখে দেখেন। আলিয়া ধারার সিলেবাসে ইংরেজি, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার অন্তর্ভুক্ত থাকলেও চাকরিদাতারা অনেক সময় তা বিবেচনায় আনেন না। ফলে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হন। ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনের মতে, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা চাকরির ক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হতে থাকবেন।
এছাড়া কওমি ধারার শিক্ষার্থীরা সরকারি নীতিমালার বাইরে থাকায় রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। অথচ তারা আরবি ভাষায় পারদর্শী, ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন এবং অনেক ক্ষেত্রেই আত্মনির্ভরশীল। সরকার চাইলে এদের বিদেশি দূতাবাস, ইসলামিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা সামাজিক উন্নয়নমূলক খাতে কাজে লাগাতে পারে। বাস্তবতা হলো, এই ধারার শিক্ষার্থীরা সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করেন এবং নিজের খরচে ইসলামিক বই প্রকাশনা, প্রশিক্ষণ, ইসলামিক সেবা বা সমাজসেবায় যুক্ত হন।
বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও মাদ্রাসা গ্র্যাজুয়েটরা পিছিয়ে। বিডিজবস ডটকমের মতে, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা মেধাহীন নন, কিন্তু কমিউনিকেশন স্কিল, প্রযুক্তি ব্যবহার ও চাকরির চাহিদা অনুযায়ী উপস্থাপনায় পিছিয়ে। ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস-এর অভিজ্ঞতায়ও দেখা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কার্যত নেই বললেই চলে। অথচ কেউ মনোযোগী হলে তারাও দক্ষতা অর্জনে সক্ষম।
ফাজিল ও কামিল শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রতি বছর বাড়লেও তা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে সুযোগ তৈরি হয়নি। শুধুমাত্র গত কয়েক বছরে প্রায় তিন লাখের বেশি শিক্ষার্থী ফাজিল ও কামিল ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, কর্মক্ষেত্রে তারা তাদের একাডেমিক জ্ঞান পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছেন। ২৬ শতাংশ বলছেন, একাডেমিক শিক্ষা কোনো কাজে লাগেনি।
এই প্রেক্ষাপটে সরকার, সমাজ ও বেসরকারি খাতকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একদিকে মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন, অন্যদিকে শ্রমবাজারে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো জরুরি। ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষার সমন্বিত ধারা তৈরি করে, কম্পিউটার, ইংরেজি, বিজ্ঞান ও যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি চাকরিদাতাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত যোগ্যতা যাচাইয়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে এই বিশাল জনগোষ্ঠী অব্যবহৃত থেকে যাবে এবং দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
চূড়ান্তভাবে বলা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে যে ব্যবধান, তা কমানো সম্ভব সমন্বিত নীতিমালার মাধ্যমে। সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহায়তা পেলে এই শিক্ষার্থীরাও দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারবেন। আর তার জন্য প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, নীতিগত সংস্কার ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
আপনার মতামত জানানঃ