আসামের পর এবার ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে মাদ্রাসার ওপর নজরদারি বাড়াবে ওই রাজ্যের ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার। সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের সংখ্যালঘুবিষয়ক দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী দানেশ আজাদ আনসারী বলেছেন, রাজ্য সরকার শিগগিরই সমীক্ষা চালাবে মাদ্রাসাগুলোতে।
এই সমীক্ষাতে দেখা হবে, জাতীয় শিশু সুরক্ষা কমিশনের নির্দেশ মেনে মাদ্রাসায় মৌলিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে কি না। ২০১১ সালের আদমশুমারি মোতাবেক উত্তর প্রদেশে প্রায় ৪ কোটি (১৯ দশমিক ২০ শতাংশ) মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন।
জাতীয় শিশু সুরক্ষা কমিশনের এক কর্মকর্তা আজ শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে উত্তর প্রদেশ সরকারের সঙ্গে অতীতে আলোচনা হয়েছে। কীভাবে এই সমীক্ষা করা যেতে পারে, তা নিয়ে সম্প্রতি আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে।’
আনসারী জানিয়েছেন, মূলত মাদ্রাসার পরিকাঠামো নিয়ে সমীক্ষা চালানো হবে। সেখানে দেখা হবে, শিশু সুরক্ষা কমিশন যেসব মৌলিক সুবিধা মাদ্রাসায় দেওয়ার কথা বলেছে, তা দেওয়া হচ্ছে কি না। যে ভবনটিতে মাদ্রাসা চলছে, সেটি সরকারি না বেসরকারি, সেখানে কত জায়গা-জমি আছে এবং সেই অনুপাতে কত ছাত্র আছে, ভবনের অবস্থা কী রকম এবং সেখানে পরিশ্রুত পানীয় জল, শৌচাগার, আসবাব এবং বিদ্যুৎ আছে কি না, এসব সমীক্ষায় খতিয়ে দেখা হবে।
উত্তর প্রদেশে এ মুহূর্তে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার মাদ্রাসা রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৫৬০টি সরকারি অনুদান পায়। গত বেশ কয়েক বছরে যেসব নতুন মাদ্রাসা হয়েছে, সেগুলোকে এখনো অনুদান দেওয়া হয় না বলে পশ্চিম উত্তর প্রদেশের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, মাদ্রাসা বোর্ড এবং বিভিন্ন মুসলমান সংগঠন বিষয়টি নিয়ে চলতি সপ্তাহেই বৈঠক করেছে। এই সমীক্ষায় তাদের আপত্তি নেই।
দেওবন্দের ওই মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা আশা করব, মানুষের স্বার্থে এবং মাদ্রাসা পরিকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য সরকার উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবেন। আমরা আশা করব, প্রচারমাধ্যমে উত্তর প্রদেশসহ ভারতের মাদ্রাসা নিয়ে যে ভুয়া তথ্য প্রচার করা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে তা বন্ধ হবে।’
২০১৮ সালে উত্তর প্রদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মাদ্রাসাতে উর্দু ছাড়াও ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা শেখানো হবে। এ ছাড়া জাতীয় শিক্ষা প্রশিক্ষণ এবং গবেষণাকেন্দ্রের পাঠ্যক্রম মাদ্রাসাতে পড়ানো হবে। বর্তমান সমীক্ষার উদ্দেশ্য, সেই পাঠ্যক্রম পড়ানোর কাজ কতটা এগিয়েছে তা–ও খতিয়ে দেখা।
তবে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিষয়টি শুধু আসামে কয়েকটি মাদ্রাসা উচ্ছেদ বা উত্তর প্রদেশে সমীক্ষা চালানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, অন্যান্য রাজ্যেও মাদ্রাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন সেই রাজ্যের বিজেপি নেতা–নেত্রীরা।
কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত এবং গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী শান্ডিল্য গিরিরাজ সিং দিন কয়েক আগে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের মাদ্রাসায় সমীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘বিহারেও এই একই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে যারা মাদ্রাসা এবং মসজিদে আশ্রয় নিচ্ছে, তাদের খুঁজে বের করা যায়।’
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার মতো তিনিও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে মাদ্রাসা ও মসজিদে জঙ্গি কার্যকলাপ চলছে।
গিরিরাজ বলেন, ‘আমাদের দাবি, নীতীশ কুমারের সরকার বিহারের মাদ্রাসা ও মসজিদগুলোতে সমীক্ষা চালাক। বিশেষ করে এই সমীক্ষা চালানো হোক মুসলিম–অধ্যুষিত সীমাঞ্চলে (পূর্ব বিহার)। আমাদের কাছে যাবতীয় তথ্য থাকা উচিত, কোনো অঞ্চলে মসজিদ ও মাদ্রাসা কারা চালাচ্ছে এবং তারাই বা সেখানে থাকছে।’
আসামে মাদ্রাসা ভাঙা, তারপর উত্তর প্রদেশের সমীক্ষা এবং বিহারের সমীক্ষা নিয়ে আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার, আগামী নির্বাচনের আগে মাদ্রাসার পঠনপাঠন এবং জঙ্গিবাদের মতো বিষয় একটি ইস্যু হিসেবে ভারতে উঠে আসবে।
এদিকে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’বোর্ড (এআইএমপিএলবি) বিজেপিশাসিত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর পক্ষ থেকে মাদ্রাসাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার অভিযোগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অনেক গুরুতর অভিযোগ করেছে বোর্ড।
মুসলিম পার্সোনাল ল’বোর্ডের অভিযোগ, বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকার মাদ্রাসার পিছনে লেগেছে। হয়রানির শিকার হচ্ছেন মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বোর্ডের প্রশ্ন- ‘কেন একই নিয়ম অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন মঠ, গুরুকুল এবং ধর্মশালাগুলোতে প্রযোজ্য নয় যা মাদ্রাসায় করা হচ্ছে?’
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানি একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) দ্বারা প্রভাবিত একটি দলের কেন্দ্রীয় সরকার এবং কিছু রাজ্য সরকার সংখ্যালঘুদের প্রতি, বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করছে।’
তিনি বলেন, ‘যখন একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত একটি দল ক্ষমতায় আসে, তাদের কাছ থেকে এটা প্রত্যাশিত যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিরপেক্ষ এবং সংবিধানের আওতার মধ্যে হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে সংসদে এবং অন্যত্র আইনশৃঙ্খলার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন, কিন্তু তার দলের নেতাদেরই তা মানতে দেখা যাচ্ছে না। বিজেপিশাসিত বিভিন্ন রাজ্য সরকারের মনোভাব বিপরীত। কেউই এই বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।’
মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানির অভিযোগ- অসম এবং উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকার খুব ছোটখাটো নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়ে মাদ্রাসাগুলোর পিছনে লেগেছে। কোনো কারণ ছাড়াই মাদ্রাসা বন্ধ করা, ভেঙে ফেলা এমনকী মাদ্রাসা ও মসজিদে কর্মরত ব্যক্তিদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এমন অনেক ঘটনা সামনে এসেছে বলেও অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানি মন্তব্য করেছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩০
আপনার মতামত জানানঃ