ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁদের ডিগ্রি ও পরীক্ষার ফলাফলের সত্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি দিল্লি হাইকোর্টের রায়ে এই প্রশ্নগুলোর অবসান হয়নি; বরং বিতর্ককে আরও ঘনীভূত করেছে। আদালত স্পষ্ট জানিয়েছে, শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কিত তথ্য ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অন্তর্ভুক্ত, তাই তা জনসমক্ষে প্রকাশ বাধ্যতামূলক নয়। এই রায় শুধু দুই রাজনৈতিক নেতাকে ঘিরে নয়, বরং ভারতের গণতন্ত্র, রাজনীতি, তথ্য জানার অধিকার আইন ও জনস্বার্থের ধারণাকেও নতুন আলোচনায় নিয়ে এসেছে।
নরেন্দ্র মোদির ডিগ্রিকে ঘিরে সংশয় তৈরি হয়েছিল অনেক আগেই। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, কৈশোরে গৃহত্যাগী হওয়ার কারণে তিনি স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। অথচ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সরকারিভাবে দাবি করা হয়, তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৮ সালে স্নাতক এবং গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর ডিগ্রির সনদও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সেখানে একাধিক অসঙ্গতি ধরা পড়ে। যেমন—দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে “এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্স” নামে কোনো বিষয় কখনো ছিল না, অথচ মোদির হলফনামায় সেই বিষয়েই স্নাতক ডিগ্রির দাবি করা হয়েছে। একইসঙ্গে, যে সনদপত্র প্রচার করা হয়, তার ফন্ট তৈরি হয়েছিল ১৯৯২ সালে, অথচ মোদি নাকি ১৯৭৮ সালে সেই সনদ পেয়েছিলেন। ফলে প্রশ্ন ওঠে, সনদ আসল নাকি ভুয়া।
এদিকে গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করে, তাদের ওয়েবসাইটেই মোদির ডিগ্রি দেওয়া আছে। কিন্তু বাস্তবে সেই নথির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই প্রেক্ষাপটে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল তথ্য জানার অধিকার আইনের আওতায় আবেদন করেছিলেন। কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়কে ডিগ্রি প্রকাশের নির্দেশ দিলেও গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় তা মানতে অস্বীকার করে। পরে গুজরাট হাইকোর্ট শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে রায়ই দেয়নি, বরং কেজরিওয়ালকে জরিমানাও করেছে আদালতের সময় নষ্ট করার অভিযোগে। এতে বোঝা যায়, ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বিতর্ক কতটা স্পর্শকাতর এবং আইনের ব্যাখ্যা কতটা রাজনৈতিক স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে স্মৃতি ইরানির ক্ষেত্রেও একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা গেছে। তাঁর দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। অনেকেই তথ্য জানার অধিকার আইনের আশ্রয় নেন। কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন সেন্ট্রাল বোর্ড অব স্কুল এডুকেশনকে ইরানির ফলাফল প্রকাশ করতে বললেও তারা তা করতে অস্বীকৃতি জানায়। এর ফলে আদালতে মামলা হয় এবং অবশেষে দিল্লি হাইকোর্ট জানিয়ে দেয়, শিক্ষাগত ফলাফল ব্যক্তিগত বিষয় এবং তা জনস্বার্থে প্রকাশ করার কোনো প্রয়োজন নেই। বিচারপতি সচিন দত্তর পর্যবেক্ষণ ছিল, জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য শিক্ষাগত ডিগ্রি বাধ্যতামূলক নয়। অর্থাৎ, গণতন্ত্রে যোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে শিক্ষা নয়, বরং জনগণের আস্থা ও ভোটই মুখ্য বিষয়।
আদালতের এই ব্যাখ্যা একদিকে ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার পক্ষে অবস্থান নেয়, অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহি নিয়ে নতুন প্রশ্ন তোলে। কারণ, ভারতের মতো বৃহৎ গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর মতো পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা কি জনস্বার্থের অন্তর্ভুক্ত নয়? সাধারণ মানুষ যখন চাকরির জন্য আবেদন করেন, তখন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জমা দিতে হয়। কিন্তু দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যদি এই যোগ্যতার প্রমাণ যাচাইয়ের আওতামুক্ত থাকে, তবে কি তা গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়? সমালোচকেরা বলছেন, আদালতের রায়ে নেতাদের প্রতি এক ধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক স্বচ্ছতাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
অন্যদিকে সমর্থকেরা বলছেন, নেতৃত্বের যোগ্যতা শুধু শিক্ষার ওপর নির্ভর করে না। ইতিহাস সাক্ষী, বহু নেতা-নেত্রী উচ্চশিক্ষা না পেয়েও অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু নেতার আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা সীমিত ছিল, কিন্তু তাঁদের নেতৃত্বে ভারত স্বাধীন হয়েছে। তাই একজন জনপ্রতিনিধির ডিগ্রি প্রকাশ বাধ্যতামূলক না করলেও তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতা, নেতৃত্বগুণ ও জনআস্থা দিয়েই যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারিত হওয়া উচিত। আদালতের রায় সেই প্রেক্ষাপটেই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে বিতর্ক এখানেই থেমে নেই। তথ্য জানার অধিকার আইন (RTI) ভারতে সাধারণ মানুষের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। এই আইনের মাধ্যমে জনগণ সরকারি কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু আদালতের এই রায় কার্যত রাজনৈতিক নেতাদের শিক্ষাগত তথ্যকে RTI-এর আওতার বাইরে নিয়ে গেল। এতে একদিকে আইনটির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, অন্যদিকে জনগণের জানার অধিকারও সীমিত হয়ে পড়ছে। সমালোচকেরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক নেতাদের জন্য এক ধরনের ঢাল হিসেবে কাজ করছে, যা তাঁদের অতীত বা ব্যক্তিগত তথ্যকে গোপন রাখার সুযোগ করে দিচ্ছে। ফলে রাজনীতির স্বচ্ছতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
মোদির ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হয়ে উঠেছে তা হলো তাঁর বক্তব্যের অসঙ্গতি। তিনি একসময় বলেছেন, তিনি স্কুল ছাড়াই গৃহত্যাগী জীবনযাপন করেছেন। আবার পরে দাবি করেছেন, তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সরকারি দলও তাঁর ডিগ্রি প্রকাশ করেছে, কিন্তু সেই ডিগ্রির সত্যতা যাচাইয়ের প্রমাণ কখনোই নিশ্চিত করা যায়নি। এই দ্বৈত অবস্থানই সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এই সন্দেহকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে বিরোধী দলগুলো। বিশেষত কেজরিওয়াল ও তাঁর আম আদমি পার্টি দীর্ঘদিন ধরে মোদির শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছে। যদিও আইনি লড়াইয়ে তাঁরা জয়ী হতে পারেননি, তবে রাজনৈতিক বিতর্কে এটি বড় একটি ইস্যু হয়ে উঠেছে।
একইভাবে স্মৃতি ইরানির শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও বিরোধী দলগুলো সমালোচনা করেছে। অভিযোগ উঠেছে, তিনি নির্বাচনী হলফনামায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। কখনো বলেছেন তিনি স্নাতক, আবার কখনো বলেছেন ডিপ্লোমা। এই অসঙ্গতি তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যদিও আদালত রায় দিয়েছে যে ফলাফল প্রকাশ বাধ্যতামূলক নয়, তবু রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে এই রায় ভারতের রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। আদালত ব্যক্তির গোপনীয়তার পক্ষে অবস্থান নিলেও রাজনৈতিক স্বচ্ছতার প্রশ্নে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেখানে ভোটাররা একজন প্রার্থীর শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, চরিত্র ও অতীত সম্পর্কে জানার অধিকার রাখেন, সেখানে শিক্ষাগত তথ্যকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অন্তর্ভুক্ত করা নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে এটি আরও নেতাদের তথ্য গোপনের পথ সহজ করবে। আবার অনেকে মনে করছেন, আদালতের এই অবস্থান শিক্ষা নয়, বরং নেতৃত্ব ও কর্মদক্ষতাকেই মুখ্য করছে।
শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি বা স্মৃতি ইরানির ডিগ্রি বিতর্কের নিষ্পত্তি হয়নি। বরং আদালতের রায় এই বিতর্ককে আরও গভীর করেছে। তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা আসলেই কী, তা হয়তো আর জানা যাবে না। তবে এই রায় একটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে—গণতন্ত্রে জনগণের জানার অধিকার কতটা বিস্তৃত হওয়া উচিত এবং রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিগত তথ্যের সীমারেখা কোথায় টানা হবে। ভারতের রাজনীতিতে এই বিতর্কের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। কারণ এটি শুধু দুই ব্যক্তিকে ঘিরে নয়, বরং গণতন্ত্রে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জনগণের অধিকার—এই তিনটি মৌলিক নীতিকে কেন্দ্র করে নতুন আলোচনার সূচনা করেছে।
আপনার মতামত জানানঃ