
ভারত এখন এমন এক অবস্থায় আছে যেখানে তার বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আঞ্চলিক বাস্তবতার মধ্যে বড় এক ফাঁক তৈরি হয়েছে। দেশটি নিজেকে পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ভেতরেই তার প্রভাব ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান—সব জায়গায় অস্থিরতা, জনবিক্ষোভ ও অর্থনৈতিক সংকট যেন একে একে ভারতের চারপাশে অস্থিতিশীলতার বলয় তৈরি করছে। অথচ নয়াদিল্লির দৃষ্টি এখন ক্রমেই বৈশ্বিক মঞ্চের দিকে সরে যাচ্ছে, যেখানে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে মহাকাশ প্রতিযোগিতা—সবই তার কূটনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে, কিন্তু নিজ অঞ্চলের সংকট যেন অদৃশ্য।
বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে জনঅভ্যুত্থান দেখা গেছে, তা শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতারও প্রতিফলন। নেপালে কেপি শর্মা অলি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন জেনারেশন-জেডের বিক্ষোভে; বাংলাদেশে ‘মনসুন রেভোলিউশন’ শেষ করেছে শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসন; শ্রীলঙ্কায় ‘আরাগালায়া’ আন্দোলন গোটাবায়া রাজাপক্ষেকে বিদায় করেছে। এই ঘটনাগুলো একত্রে প্রমাণ করে যে দক্ষিণ এশিয়া আজ গভীর সংকটে। দুর্নীতি, বেকারত্ব, তরুণদের ক্ষোভ, রাজনৈতিক অবিশ্বাস—সব মিলিয়ে অঞ্চলটি যেন আগুনের উপর বসে আছে। অথচ এই সময়ে ভারত নিজের ভূমিকা নিয়ে চিন্তা করার পরিবর্তে বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ব্যস্ত।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর নরেন্দ্র মোদি প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের অঙ্গীকার করেছিলেন—‘সবার আগে প্রতিবেশী’ নীতি দিয়েছিলেন তিনি। প্রথম দফায় সার্কের সব দেশের নেতাকে তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নীতি হারিয়ে যায়। আজ ভারতের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিবেশীরা নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, রাশিয়া ও চীনের মতো শক্তিধর দেশগুলো। রাইসিনা ডায়ালগ বা জি-২০ সম্মেলনের মতো মঞ্চে দক্ষিণ এশিয়ার অস্থিরতা নিয়ে আলোচনা প্রায় অনুপস্থিত। অথচ এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা না থাকলে ভারতের জন্যও শান্তি বা সমৃদ্ধি টেকসই হতে পারে না।
ভারতের এই ‘উদাসীনতা’ শুধু কূটনীতিতে নয়, তার সীমান্ত অঞ্চলেও প্রতিফলিত হচ্ছে। লাদাখ ও মণিপুরে সাম্প্রতিক অস্থিরতা দেখায় যে কেন্দ্রীয় সরকারের মনোযোগ অনেক দূরের বিষয়ে, ঘরের ভেতরের সমস্যা নয়। মণিপুরের সংঘাত দুই বছরের বেশি সময় ধরে চললেও মোদি সেখানে সফরে যাননি দীর্ঘ সময়। এই উদাসীনতা ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন ভারতের পূর্বমুখী সংযোগ স্থবির করে দিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে স্থলপথে সরাসরি যোগাযোগের স্বপ্ন এখন ঝুলে আছে।
ভারতের পশ্চিমমুখী নীতিও চ্যালেঞ্জে ভরা। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অস্থিরতা, মধ্যপ্রাচ্যের জটিলতা, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের নতুন প্রতিরক্ষা জোট—সবকিছু মিলিয়ে নয়াদিল্লির প্রভাব সেখানে সীমিত। যদিও চাবাহার বন্দর বা ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ করিডর ভারতের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ, কিন্তু এগুলো এখনো কাগজে কলমে। মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের অবস্থান চীনের তুলনায় অনেক দুর্বল। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক সংযোগও ন্যূনতম—আঞ্চলিক বাণিজ্য মাত্র ৫ শতাংশ, যা বিশ্বের সবচেয়ে কম আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যের একটি।
চীন এখানে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। চীন আঞ্চলিক সংযোগ, অবকাঠামো ও অর্থনীতির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল—সব জায়গায় চীনা বিনিয়োগ ও প্রকল্প দৃশ্যমান। ভারত এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে, কারণ সে তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে পারস্পরিক আস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। এমনকি অনেক দেশেই ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছে। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রচারে ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান বা মালদ্বীপে একই প্রবণতা—এই বাস্তবতা উপেক্ষা করা যায় না।
তবুও, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কাছে ভারত এখনো গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপ যখন আর্থিক সংকটে পড়েছে, তখন শেষ মুহূর্তে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে নয়াদিল্লি। কিন্তু এ ধরনের সহায়তা সম্পর্ককে টেকসই করে না, যদি রাজনৈতিক আস্থা না থাকে। ভারতের উচিত হবে তার কূটনীতিতে নতুনভাবে প্রতিবেশীদের গুরুত্ব দেওয়া। বৈশ্বিক মঞ্চে ভারতের সাফল্য অর্থবহ হবে তখনই, যখন দক্ষিণ এশিয়া স্থিতিশীল থাকবে এবং ভারত নেতৃত্বের জায়গায় আস্থা অর্জন করবে।
রাজনৈতিক দিক থেকেও দক্ষিণ এশিয়া এখন রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। পুরোনো রাজনৈতিক পরিবারগুলো দুর্বল হচ্ছে, তরুণ নেতৃত্ব ও নতুন দলগুলো উঠে আসছে। শ্রীলঙ্কায় বামপন্থী নেতা অনুড়া কুমারা দিসানায়েকে ঐতিহ্যবাহী রাজবংশীয় রাজনীতিকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। বাংলাদেশে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার চলছে, নেপালে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি আছেন একই ভূমিকায়। এই পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে নতুন পথে নিয়ে যাচ্ছে—যেখানে জনগণের শক্তি ও তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা মূল চালিকা শক্তি।
এই সময় ভারতের সামনে দুটি পথ খোলা। এক, সে যদি সত্যিই বৈশ্বিক শক্তি হতে চায়, তবে তাকে প্রথমে নিজের অঞ্চলে নেতৃত্ব দিতে হবে। চীনও বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার আগে আঞ্চলিক অর্থনীতি ও সংযোগের কেন্দ্র তৈরি করেছিল। ভারতও যদি সেই পথে হাঁটে—বাণিজ্য, অবকাঠামো, শিক্ষা, জলবায়ু ও অভিবাসন ইস্যুতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ নেয়—তাহলে তার প্রভাব অনেক বেশি টেকসই হবে। দুই, ভারত যদি প্রতিবেশীদের উপেক্ষা করে কেবল পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বাড়ায়, তবে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা একসময় তার বৈশ্বিক অবস্থানকেও দুর্বল করবে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো ১৮ বছরের নিচে, অর্থাৎ এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তরুণদের হাতে। জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আঞ্চলিক সহযোগিতা অপরিহার্য। পশ্চিমা দেশগুলোকেও এখন দক্ষিণ এশিয়াকে আলাদা দেশগুলোর সমষ্টি নয়, বরং একটি আন্তঃনির্ভর অঞ্চল হিসেবে দেখতে হবে। কারণ, এখানে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক প্রবণতা বৈশ্বিক প্রভাব ফেলে।
ভারতের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানসিকতার পরিবর্তন। তাকে বুঝতে হবে, বৈশ্বিক পরাশক্তি হওয়া মানে কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে গুরুত্ব পাওয়া নয়; বরং নিজের চারপাশে স্থিতিশীলতা, আস্থা ও সহযোগিতা গড়ে তোলা। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও সংহতি নিশ্চিত না করে ভারতের উত্থান অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
এই সময় ভারতের সামনে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো—“প্রতিবেশীদের বাদ দিয়ে কি সত্যিই পরাশক্তি হওয়া সম্ভব?” ইতিহাস বলে, কোনো দেশই নিজের ভৌগোলিক অঞ্চলে প্রভাব হারিয়ে বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে পারেনি। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। যদি সে নিজের চারপাশে নতুন আস্থা ও সংহতি তৈরি করতে না পারে, তবে তার পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ