আসামের ডিব্রুগড় শহরে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানে গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে ভেঙে ফেলা হয়েছে একটি ১২৮ বছরের পুরনো মসজিদ, যার নাম ছিল চাউলখোয়া জামা মসজিদ। শহরের বকুল এলাকা থেকে সেসা সেতু পর্যন্ত একটি প্রধান নিষ্কাশন ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিব্রুগড় পৌর বোর্ডের কমিশনার জয় বিকাশ। তিনি দাবি করেন, শহরের কৃত্রিম বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এই প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং তাই শহরের বৃহত্তর স্বার্থে মসজিদটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে প্রশাসনের বক্তব্য, মসজিদ ভাঙার আগে সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে এবং স্থানীয় বাসিন্দারা এতে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন।
তবে ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, জেলা প্রশাসন জোর করে মসজিদটি ভেঙে ফেলেছে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুভূতিকে উপেক্ষা করেছে। যদিও চাউলখোয়া জামা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি লিয়াকত আলী জানান, এটি কোনও উচ্ছেদ ছিল না বরং বৈধ জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই মসজিদটি ভাঙা হয়েছে। অর্থাৎ দুই পক্ষের সম্মতিতেই এই কাজটি সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
এই ঘটনাটি নিছক একটি স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ বলে দেখালেও, তা ভারতের সাম্প্রতিক সময়ের একটি বড় প্রবণতার সঙ্গে মিলে যায়—যেখানে মসজিদ ধ্বংসকে ঘিরে একটি নিঃশব্দ সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি ও গুজরাটে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ, রাস্তা সম্প্রসারণ অথবা ‘অবৈধ স্থাপনা’ উচ্ছেদের অজুহাতে বহু প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মসজিদ বা ধর্মীয় স্থাপনা ভাঙার ঘটনা ঘন ঘন ঘটছে। ২০২২ সালে দিল্লির মাদনপুর খাদর এলাকায় শতবর্ষ পুরনো আকোনজি মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয় মেট্রোর রাস্তা নির্মাণের জন্য। এর আগে ২০২০ সালে এলাহাবাদে শাহী মসজিদের একটি অংশ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল অযোধ্যা ইস্যুর উত্তাপের মধ্যে। এই ঘটনাগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রশাসন ‘অবৈধ দখল’ কিংবা ‘সরকারি জমি’ উদ্ধারের অজুহাত দেখালেও, মুসলিম সমাজের একাংশ মনে করে এসব সিদ্ধান্ত একতরফাভাবে এবং ধর্মীয় সংবেদনশীলতা বিবেচনা না করেই নেওয়া হচ্ছে।
তদ্ব্যতীত, কিছু কিছু ঘটনায় দেখা গেছে যে মসজিদ ধ্বংসের আগে কোনও রকম নোটিশ পর্যন্ত দেয়া হয়নি বা আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে কার্যক্রম চালানো হয়েছে। ফলে বিষয়টি শুধুমাত্র জমি উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না বরং একটি গভীর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান এবং ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা সামাজিক সাম্যবোধে চিড় ধরাচ্ছে বলে মত দেন অনেকে।
ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিটি ধর্মের উপাসনাস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বললেও, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনাগুলিই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে একপাক্ষিকভাবে মসজিদ ভেঙে ফেলা, অথবা আদালতের আদেশ ব্যতিরেকে এমন কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতে আরও বিভাজনের জন্ম দিতে পারে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ, আতঙ্ক এবং অবিশ্বাস ক্রমবর্ধমান।
ডিব্রুগড়ের মসজিদ ভাঙার ঘটনায় স্থানীয়দের সম্মতি এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের কথা বলা হলেও, ভারতের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের কাজ একটি দীর্ঘদিনের সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই উঠে আসে—যেখানে মুসলিম স্থাপনাগুলিকে বারবার টার্গেট করা হয়েছে উন্নয়নের ছদ্মাবরণে। সমাজের স্থিতিশীলতা ও ধর্মীয় সহাবস্থানের জন্য এটি এক অশনিসংকেত। তাই ভবিষ্যতে উন্নয়নের নামে ধর্মীয় স্থাপনার ধ্বংস যেন আরেকটি বিতর্কের আগুন না ছড়ায়, তা নিশ্চিত করতে চাই স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত, এবং সর্বোপরি মানবিক বিবেচনা।
আপনার মতামত জানানঃ