বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায় তরুণ প্রজন্মের বিদেশমুখিতা এক গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণ ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশা, অন্যদিকে দেশের জন্য সম্ভাবনাময় মেধার হারানো—এই দ্বন্দ্ব একটি জাতির ভবিষ্যৎকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আজকের তরুণেরা বিদেশে পড়াশোনা, পেশাগত জীবন কিংবা স্থায়ী বসবাসের আশায় দেশ ছাড়ছে। এ প্রক্রিয়ায় দেশ তার সবচেয়ে বড় সম্পদ—মানবসম্পদ—হাতে রাখতে পারছে না। প্রায়শই দেখা যায়, দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, শিক্ষার সীমাবদ্ধতা, কর্মসংস্থানের ঘাটতি, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সংকট ও উন্নত জীবনমানের আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করছে।
বাংলাদেশের মেধাবী তরুণরা একসময় দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেকে বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসে না। শিক্ষা ও গবেষণার আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, পেশাগত প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনভাবে জীবন পরিচালনার সুযোগ তাদেরকে বিদেশমুখী করছে। ২০২৪ সালেই প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে গিয়েছে, যাদের বড় অংশ স্থায়ী বসবাসের পরিকল্পনা নিয়ে দেশ ছাড়ে। এ অবস্থাকে ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বলা যায়—দেশ থেকে মেধা চলে যাচ্ছে, কিন্তু তা দেশের কাজে লাগছে না। যারা ফিরে আসেন, তারা অনেক সময় দেশের কাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় নিজেদের পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারেন না।
রাজনৈতিক অস্থিরতা তরুণদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। তারা অনুভব করে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত, নতুন চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্র সংকুচিত। অন্যদিকে শিক্ষার মান উন্নত দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে থাকায় গবেষণায় মনোযোগী তরুণেরা বিদেশে বেশি সুযোগ খুঁজে পায়। দেশে মানসম্মত গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় মেধাবীরা হতাশ হয়।
অন্য একটি বড় কারণ হলো উন্নত জীবনযাত্রার আকাঙ্ক্ষা। বিদেশে পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও নাগরিক অধিকার তুলনামূলকভাবে উন্নত। ফলে তারা বিশ্বাস করে, বিদেশে গেলে নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আরও ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে। তবে বাস্তবতা সবসময় সুখকর হয় না। অনেকেই বিদেশে সফল হয়ে পরিবার ও দেশকে সাহায্য করে, কিন্তু অনেকেই নতুন সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
যদি এই বিদেশমুখী ধারা অব্যাহত থাকে, বাংলাদেশ দক্ষ জনশক্তির অভাব, নেতৃত্ব সংকট ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার মুখে পড়বে। দেশের প্রগতিশীল অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হবে। তাই এখনই তরুণ প্রজন্মকে দেশে ধরে রাখার পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এর প্রথম শর্ত হলো শিক্ষার মান উন্নয়ন। কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা সম্প্রসারণ করে বাজারমুখী দক্ষতা তৈরি করতে হবে। আধুনিক সিলেবাস, প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা, উদ্যোক্তা মনোভাব ও গবেষণার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ইংরেজি ও ডিজিটাল দক্ষতায় বিশেষ জোর দেওয়া উচিত, কারণ আন্তর্জাতিক চাকরি ও সুযোগে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
একই সঙ্গে উদ্যোক্তা সংস্কৃতি গড়ে তোলা জরুরি। তরুণদের স্টার্টআপে উৎসাহিত করার জন্য সহজ শর্তে ঋণ, অনুদান ও বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ইনকিউবেটর, মেন্টরশিপ, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করলে তরুণেরা দেশের ভেতরেই নতুন কিছু করার সাহস পাবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে তরুণদের বিদেশমুখিতা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ে চাকরি মেলা, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও দক্ষতা ভিত্তিক চাকরি প্রশিক্ষণ চালু করা যেতে পারে। কৃষি প্রযুক্তি, গ্রীন এনার্জি, ডিজিটাল সার্ভিস, উৎপাদন ও সৃজনশীল খাত সম্প্রসারণ করে দেশে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব।
চাকরির মান উন্নয়নও গুরুত্বপূর্ণ। তরুণেরা শুধুমাত্র চাকরি নয়, বরং নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ন্যায্য বেতন ও সামাজিক সুরক্ষা আশা করে। এজন্য শ্রম আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। নারীদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। স্বাস্থ্যবীমা, সামাজিক নিরাপত্তা ও সঠিক কর্মপরিবেশ তরুণদের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাত তরুণদের জন্য অসীম সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করছে। প্রত্যন্ত গ্রামেও ইন্টারনেট ও কম্পিউটার শিক্ষা পৌঁছে দিতে হবে। হ্যাকাথন, প্রতিযোগিতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আইটি সেক্টরে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব। একই সঙ্গে গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ জরুরি।
নীতিমালা ও প্রশাসনিক জটিলতা তরুণ উদ্যোক্তাদের অন্যতম বাধা। সহজ ভিসা, লাইসেন্স, কর প্রক্রিয়া, ব্যবসা নিবন্ধন প্রক্রিয়া তরুণদের জন্য আরও সরল করতে হবে। তরুণদের মতামত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত।
প্রবাসে যাওয়া তরুণদেরও দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো সম্ভব। বিদেশে অভিজ্ঞতা অর্জন করা তরুণদের দেশে ফিরিয়ে এনে নতুন কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা খাতে যুক্ত করতে হবে। পুনঃপ্রশিক্ষণ, রিহায়ারিং ও প্রবাসী উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেওয়া হলে তাদের অভিজ্ঞতা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগবে।
বাংলাদেশের প্রায় ৪৫% মানুষ তরুণ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এই ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’কে কাজে লাগানো না গেলে এটি এক ভয়াবহ সম্ভাবনার অপচয় হবে। তরুণরা যদি দেশে থেকেই স্টার্টআপ, কৃষি উদ্ভাবন, ডিজিটাল সেবা, ই-কমার্স, গ্রামীণ উন্নয়ন ইত্যাদিতে যুক্ত হয়, তবে অর্থনীতি ভেতর থেকেই শক্তিশালী হবে। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স একটি বড় উৎস হলেও, দেশীয় কর্মসংস্থানই টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে তোলে।
সবচেয়ে বড় কথা, তরুণরা দেশ ছাড়ে না—তারা সুযোগের খোঁজে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। সেই সুযোগগুলো যদি আমরা দেশের ভেতরেই তৈরি করতে পারি, তবে বিদেশমুখিতা কমবে। সরকারকে বুঝতে হবে, উন্নয়ন মানে শুধু জনশক্তিকে বিদেশে পাঠানো নয়, বরং দেশীয় প্রতিভাকে কাজে লাগানো। তরুণদের সস্তা শ্রমিক হিসেবে নয়, বরং জ্ঞানভিত্তিক সমাজের নির্মাতা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
আজকের সংকট তাই তরুণদের দোষ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের ঘাটতির প্রতিফলন। তরুণদের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার জায়গা শক্তিশালী করতে পারলেই তারা দেশেই থেকে নতুন বাংলাদেশ গড়বে। ভবিষ্যতে যেই সরকার ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের উচিত তরুণদের জন্য আশাব্যঞ্জক, স্থিতিশীল ও স্বপ্নময় পরিবেশ তৈরি করা। বিদেশমুখিতা বন্ধ হবে না আইন দিয়ে, বরং সুযোগ, নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করেই। তরুণদের যদি দেশের ভেতরেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের রাস্তা তৈরি হয়, তবে উন্নত বাংলাদেশের ভিত্তি এখানেই স্থাপিত হবে।
আপনার মতামত জানানঃ