বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও প্রশাসনের চরিত্র নিয়ে যে প্রশ্নগুলো বহুদিন ধরে চাপা পড়ে ছিল, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর সেগুলো নতুন করে সামনে এসেছে। মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এই অভ্যুত্থান কেবল একটি সরকারের পতন নয়, বরং দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী রীতিনীতির অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন, ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা করবে। কিন্তু অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতা ক্রমেই ইঙ্গিত দিচ্ছে, পুরোনো প্রথা ও মানসিকতার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটানো যতটা সহজ মনে করা হয়েছিল, বাস্তবে তা ততটাই কঠিন। সরকারি চাকরিতে তথাকথিত ভেরিফিকেশনের নামে রাজনৈতিক পরিচয় ও আনুগত্য যাচাইয়ের ধারাবাহিকতা সেই পুরোনো কর্তৃত্ববাদী ছাঁচেরই পুনরাবৃত্তি, যা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
সরকারি চাকরি আধুনিক রাষ্ট্রে কেবল জীবিকার মাধ্যম নয়; এটি রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু। মেধা, যোগ্যতা ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করাই সংবিধান ও আইনের মূল কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এই নীতির সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক দীর্ঘদিনের। রাজনৈতিক পরিচয়, মতাদর্শ কিংবা পারিবারিক সম্পর্ক—এসব বিষয় যে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অঘোষিত মানদণ্ড হয়ে উঠেছে, তা নতুন কিছু নয়। পার্থক্য হলো, গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষ ভেবেছিল এই চর্চার অবসান ঘটবে। অথচ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো দেখাচ্ছে, ভেরিফিকেশনের নামে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যাচাই এখনো সক্রিয় এবং অনেক ক্ষেত্রে আরও সূক্ষ্ম ও বিস্তৃত আকার ধারণ করেছে।
৪৩তম বিসিএসের গেজেট থেকে প্রার্থীদের বাদ পড়ার ঘটনা এই বাস্তবতার একটি স্পষ্ট উদাহরণ। লিখিত, মৌখিক ও অন্যান্য ধাপ পেরিয়ে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার পরও শত শত প্রার্থীকে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বাদ দেওয়া হয়েছে। কারও ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে তিনি একটি নির্দিষ্ট জেলার বাসিন্দা, কারও ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়, আবার কারও ক্ষেত্রে পরিবারের দূরবর্তী কারও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা—সব মিলিয়ে একটি অদৃশ্য অথচ শক্তিশালী ছাঁকনি কাজ করছে, যার মানদণ্ড আইনসম্মত নয়, স্বচ্ছ নয় এবং জবাবদিহিতার বাইরে। এই অনিশ্চয়তা শুধু কয়েকজন চাকরিপ্রার্থীর ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য নয়; এটি রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আস্থাকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রশাসনকে নিরপেক্ষ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান না রেখে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর অনুগত যন্ত্রে পরিণত করা। ইতিহাসে এর বহু উদাহরণ আছে। প্রশাসনে আনুগত্যকে যোগ্যতার ওপরে স্থান দিলে রাষ্ট্রযন্ত্র ধীরে ধীরে গণস্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন শাসনামলে এই প্রবণতা কমবেশি বিদ্যমান ছিল। একেক সময় একেক দল বা শাসক প্রশাসনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছে, ফলে আমলাতন্ত্র পেশাদারিত্ব হারিয়েছে এবং বিভক্ত হয়েছে রাজনৈতিক রেখায়। এর দীর্ঘমেয়াদি ফল হলো দুর্বল প্রতিষ্ঠান, অকার্যকর প্রশাসন এবং নাগরিকদের মধ্যে গভীর অনাস্থা।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা হওয়ার কথা সামাজিক চুক্তির রক্ষক হিসেবে কাজ করা। নাগরিকরা তাদের কর, আনুগত্য ও আইন মেনে চলার বিনিময়ে যে সেবা ও নিরাপত্তা প্রত্যাশা করে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রশাসনের। কিন্তু যখন প্রশাসনের সদস্যরা জনগণের আইনের বদলে কোনো দল, মতাদর্শ বা গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে বাধ্য হন, তখন সেই সামাজিক চুক্তি কার্যত ভেঙে পড়ে। রাষ্ট্র তখন আর সকলের রাষ্ট্র থাকে না; হয়ে ওঠে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার কাঠামো।
ভেরিফিকেশনের নামে রাজনৈতিক পরিচয় যাচাইয়ের বর্তমান চর্চা সেই ভাঙনেরই আরেকটি ধাপ। এখানে শুধু চাকরিপ্রার্থীর নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানই নয়, পরিবার, আত্মীয়স্বজন এমনকি দূরবর্তী সম্পর্কও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কাউকে “অমুক মতাদর্শী”, “অমুক মনোভাবাপন্ন” বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যার কোনো আইনি সংজ্ঞা নেই, প্রমাণের মানদণ্ড নেই এবং প্রতিকার পাওয়ার পথও অস্পষ্ট। এতে একদিকে যোগ্য প্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে প্রশাসনে ঢুকছেন তারা, যাদের প্রধান যোগ্যতা আনুগত্য। এই প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকেই দুর্বল করে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল তারা এই চর্চার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেবে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রাজনৈতিক ভেরিফিকেশন বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণাও হয়েছিল। কিন্তু সিদ্ধান্ত আর বাস্তবায়নের মধ্যকার ব্যবধান ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। বাস্তবে ভেরিফিকেশন প্রথা বহাল থাকছে, নিয়োগ আটকে যাচ্ছে, গেজেট বাতিল হচ্ছে—সবই প্রমাণ করে যে পুরোনো কাঠামো ও মানসিকতা এখনো শক্তভাবে টিকে আছে। এতে প্রশ্ন জাগে, সংস্কার কি আদৌ আন্তরিক, নাকি কেবল জনমত সামাল দেওয়ার কৌশল?
এই পরিস্থিতিতে আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও আদর্শিক গোষ্ঠীর প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। ক্ষমতার শূন্যতা বা পরিবর্তনের সময় আমলাতন্ত্রকে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা নতুন নয়। কিন্তু যখন এই প্রতিযোগিতা প্রকাশ্য হয়ে ওঠে এবং প্রশাসনিক নিয়োগ ও পদায়নে প্রভাব ফেলে, তখন রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ চরিত্র গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রশাসন তখন আর জনগণের সেবা করে না; বরং ক্ষমতার ভারসাম্যের খেলায় একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়।
এর সামাজিক প্রভাবও গভীর। তরুণ প্রজন্ম, যারা মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সেবায় যুক্ত হতে চায়, তারা হতাশ হয়। তারা দেখে, পরীক্ষায় ভালো করলেও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে এমন কিছু বিষয়ের ওপর, যেগুলোর ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই হতাশা দীর্ঘমেয়াদে দেশ থেকে মেধাপলায়ন, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। রাষ্ট্রের জন্য এটি একটি নীরব কিন্তু মারাত্মক ক্ষতি।
সংবিধান ও আইন স্পষ্টভাবে বলছে, সরকারি চাকরিতে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে হবে এবং নিয়োগের ভিত্তি হবে মেধা ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা। এই নীতির লঙ্ঘন কেবল প্রশাসনিক অন্যায় নয়, এটি রাষ্ট্রবিরোধী কাজও বটে। কারণ এর মাধ্যমে রাষ্ট্র নিজেই তার ঘোষিত আদর্শ ও আইনি কাঠামোকে অস্বীকার করে। যখন আইন কাগজে থাকে আর বাস্তবে চলে অঘোষিত নিয়ম, তখন রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান মানুষকে নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিল—একটি বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল পুরোনো কর্তৃত্ববাদী রীতির সঙ্গে স্পষ্ট ও সাহসী বিচ্ছেদ। সরকারি চাকরিতে রাজনৈতিক ভেরিফিকেশনের মতো প্রথা বহাল থাকা মানে সেই বিচ্ছেদ ঘটেনি, বরং ভেতরে ভেতরে আরেকটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনের পুনঃপ্রস্তুতি চলছে—এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।
রাষ্ট্র সংস্কার কেবল কমিশন গঠন বা ঘোষণা দিয়ে হয় না; হয় দৈনন্দিন প্রশাসনিক চর্চার মধ্য দিয়ে। একজন চাকরিপ্রার্থী ন্যায্যতা পেল কি না, একজন নাগরিক রাষ্ট্রের কাছে সম্মান ও নিরাপত্তা পেল কি না—এই ছোট ছোট অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র প্রকাশ পায়। যদি সেই অভিজ্ঞতা বারবার বৈষম্য, অনিশ্চয়তা ও অবিচারের হয়, তবে গণতন্ত্র কাগজে থাকলেও বাস্তবে তার কোনো অর্থ থাকে না।
আজ বাংলাদেশের সামনে প্রশ্নটি খুব সরল কিন্তু গভীর—রাষ্ট্র কি নাগরিকদের হবে, নাকি নাগরিকরা রাষ্ট্রের কাছে কেবল সন্দেহভাজন ও অনুগত প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হবে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ধারিত হবে প্রশাসনকে কীভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে, তার ওপর। ভেরিফিকেশনের নামে রাজনৈতিক আনুগত্য যাচাই চলতে থাকলে তা শুধু কিছু মানুষের চাকরি পাওয়া না-পাওয়ার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ থাকবে না; এটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পথচলাকেই নির্ধারণ করে দেবে।
আপনার মতামত জানানঃ