আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ব্যতিক্রমী। এই অনিশ্চয়তার মূল কেন্দ্রে রয়েছে দোদুল্যমান বা সুইং ভোটারদের অস্বাভাবিক উত্থান, যা প্রচলিত রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশকে ক্রমেই অকার্যকর করে তুলছে। বিভিন্ন নির্বাচনপূর্ব জরিপে দেখা যাচ্ছে, প্রায় অর্ধেক ভোটার এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। ইনোভিশনের জরিপ অনুযায়ী এই হার প্রায় ৪৯ শতাংশ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুইং ভোটার নতুন কোনো ধারণা নয়, কিন্তু তাদের সংখ্যা যখন মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, তখন নির্বাচনের ফলাফল শুধু অনিশ্চিতই নয়, অনেক ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত ও অস্থির হয়ে ওঠে।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানের ভাষায় এই পরিস্থিতিকে বলা হয় ‘ক্রিটিক্যাল ভোলাটিলিটি’। অর্থাৎ ভোটারদের মনোভাব এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যেখানে সামান্য ঘটনাও বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। এই ধরনের বাস্তবতায় শক্তিশালী একদলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠনের সম্ভাবনা কমে আসে এবং ঝুলন্ত সংসদ বা ভঙ্গুর জোট সরকারের ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতি সেই দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।
সুইং ভোটারদের আচরণ বোঝা রাজনৈতিক বিশ্লেষণের সবচেয়ে জটিল ক্ষেত্রগুলোর একটি। একসময় ধারণা ছিল, এই ভোটাররা রাজনৈতিকভাবে উদাসীন বা অজ্ঞ। কিন্তু আধুনিক গবেষণা সেই ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে। নতুন তত্ত্ব অনুযায়ী, সুইং ভোটাররা আসলে ‘ইনফরমেশন ম্যাক্সিমাইজার’। তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে, বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, তারপর সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সিদ্ধান্ত আবেগ, পরিচয়, অর্থনৈতিক প্রত্যাশা, নেতৃত্বের প্রতি আস্থা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কার সম্মিলিত ফল।
এই আচরণ ব্যাখ্যায় ‘প্রসপেক্ট থিওরি’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষ লাভের চেয়ে ক্ষতিকে বেশি গুরুত্ব দেয়। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বা সামাজিক পরিস্থিতি খারাপ হলে ভোটাররা বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে ঝুঁকি নিতে রাজি হয়। তখন তারা ‘পানিশমেন্ট ভোটিং’-এর মাধ্যমে সরকার বা প্রভাবশালী দলকে শাস্তি দিতে চায়। আবার পরিস্থিতি তুলনামূলক স্থিতিশীল হলে অনেক সুইং ভোটার ঝুঁকি এড়িয়ে সম্ভাব্য বিজয়ী দলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই দ্বিমুখী প্রবণতাই তাদের আচরণকে অনিশ্চিত করে তোলে।
বিশ্ব রাজনীতির অভিজ্ঞতা দেখায়, সুইং ভোটারদের বড় উত্থান বহু দেশে ঝুলন্ত সংসদ ও অস্থির সরকার জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট গণভোট এর অন্যতম উদাহরণ। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জরিপগুলো ‘রিমেইন’-এর পক্ষে থাকলেও সুইং ভোটাররা শেষ সময়ে ‘লিভ’-এর দিকে ঝুঁকে পড়ে পুরো রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দেন। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা যায়। জাতীয় পর্যায়ে হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে থাকলেও কয়েকটি সুইং স্টেটে ক্ষুদ্র পরিবর্তনই নির্বাচনের ফল উল্টে দেয়।
অস্ট্রেলিয়ার ২০১৯ সালের নির্বাচন রাজনৈতিক জরিপের সীমাবদ্ধতাকে নগ্নভাবে সামনে আনে। প্রায় সব জরিপে লেবার পার্টির জয়ের পূর্বাভাস থাকলেও সুইং ভোটারদের শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্ত কনজারভেটিভদের ক্ষমতায় রাখে। এই অভিজ্ঞতাকে অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আখ্যা দিয়েছেন ‘দ্য পোলস্টার্স ডার্কেস্ট আওয়ার’ নামে। ইউরোপেও একই চিত্র দেখা গেছে। ইতালিতে ২০১৩ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর একাধিকবার সরকার গঠন ও ভাঙনের ঘটনা ঘটে। স্পেনে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে চারবার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, মূলত ঝুলন্ত সংসদ ও দুর্বল জোট সরকারের কারণে।
ইসরায়েল গত ছয় বছরে পাঁচটি জাতীয় নির্বাচন করেছে, যেখানে সুইং ভোটার ও ক্ষুদ্র দলগুলোর ভূমিকা ছিল নির্ধারক। নেপাল ও থাইল্যান্ডেও একই ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা গেছে। এসব দেশের অভিজ্ঞতা বলছে, যেখানে ভোটারদের আনুগত্য স্থির নয় এবং দলগুলো দীর্ঘমেয়াদি ঐকমত্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ, সেখানে সুইং ভোটাররা পুরো ব্যবস্থাকে অস্থির করে তুলতে পারে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই অভিজ্ঞতাগুলো বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। জরিপে প্রায় অর্ধেক ভোটার অনিশ্চিত থাকায় ঝুলন্ত সংসদের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এই অনিশ্চয়তা ছোট ও মধ্যম আকারের দলগুলোর জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছে। সামান্য ভোট বৃদ্ধিও তাদের জোট রাজনীতির কেন্দ্রীয় খেলোয়াড়ে পরিণত করতে পারে। ফলাফল হিসেবে একটি শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের বদলে বহু দলের সমর্থননির্ভর একটি দুর্বল সরকার গঠিত হতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস দেখায়, এই ধরনের জোট সরকার সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। পাকিস্তানে ১৯৮৮ সালের পর কোনো জোট সরকার দুই বছরের বেশি টেকেনি। শ্রীলঙ্কায় ২০০২ সালের ইউনাইটেড ন্যাশনাল ফ্রন্টের সরকার মাত্র দুই বছরেই ভেঙে পড়ে। নেপালে ২০০৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে একের পর এক সরকার পরিবর্তন হয়েছে, যার বেশির ভাগই ছিল ভঙ্গুর জোট। ইতালিতে সরকার টিকে থাকার গড় সময় মাত্র ১৪ মাস। এসব উদাহরণ দেখায়, ঝুলন্ত সংসদ শুধু রাজনৈতিক সমঝোতার চ্যালেঞ্জই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও বড় বাধা।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরও জটিল। রাজনৈতিক অঙ্গনে পতিত আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাঠামো ও কর্মীরা এখনো পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় নয়। একটি শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠিত হলে তাদের পুনরুত্থান কঠিন হবে। কিন্তু একটি ঝুলন্ত সংসদ বা দুর্বল জোট সরকারের ভেতরের দ্বন্দ্ব ও বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ক্ষমতাচ্যুত দলগুলো ঠিক এই কৌশলেই রাজনীতিতে ফেরার পথ খুঁজেছে।
এই বাস্তবতায় আসন্ন নির্বাচন শুধু ক্ষমতা বদলের প্রশ্ন নয়; এটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। সুইং ভোটাররা একদিকে স্থিতিশীলতা চান, অন্যদিকে ক্ষমতার ভারসাম্যও বিবেচনায় রাখেন। কোন বার্তা, কোন আবেগ বা কোন কৌশল তাদের শেষ মুহূর্তে প্রভাবিত করবে, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার—এই প্রায় ৪৯ শতাংশ ভোটারের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সরকার পাবে, নাকি একটি স্বল্পস্থায়ী ও ঝুলন্ত সংসদের বাস্তবতায় প্রবেশ করবে।
যদি দ্বিতীয় পরিস্থিতিই বাস্তবায়িত হয়, তবে তা হবে বড় ধরনের শঙ্কার কারণ। বাংলাদেশের সামনে এমনিতেই রয়েছে অর্থনৈতিক চাপ, প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ, সামাজিক বিভাজন ও আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন। একটি দুর্বল সরকার এসব চাপ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে পারে। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়ার ঝুঁকি থাকবে। এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর এখনই তাদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। নির্বাচন শুধু জয়ের অঙ্ক নয়; এটি পরবর্তী সরকার কতটা কার্যকর ও স্থিতিশীল হবে, সেই প্রশ্নের সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত।
আপনার মতামত জানানঃ