ঢাকার একটি সমাবেশে উচ্চারিত একটি বক্তব্য মুহূর্তেই দুই প্রতিবেশী দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন করে উত্তাপ ছড়িয়েছে। বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্য, যা ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত, সেগুলোকে ভারত থেকে আলাদা করার হুমকির কথা বলার পর বিষয়টি আর কেবল একটি রাজনৈতিক মঞ্চের বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর প্রতিধ্বনি শোনা গেছে দিল্লি থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত, আর ঢাকায়ও সরকার ও রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে ব্যাখ্যা, প্রতিক্রিয়া ও দূরত্ব তৈরির চেষ্টা।
এই বক্তব্যটি আসে এমন এক সময়ে, যখন বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক ইতোমধ্যেই নানা কারণে চাপে রয়েছে। গত বছরের আগস্টের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি নিয়ে কূটনৈতিক মহলে আলোচনা চলছিল। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে ঘিরে ভারতের অবস্থান, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য ও রাজনৈতিক আশ্রয়–প্রশ্রয়—সব মিলিয়ে পারস্পরিক অবিশ্বাসের আবহ ঘনীভূত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের আঞ্চলিক অখণ্ডতা নিয়ে প্রকাশ্য হুমকির মতো বক্তব্য দিল্লির কাছে স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে।
হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তৃতার ভাষা ছিল তীব্র ও আক্রমণাত্মক। তিনি অভিযোগ করেন, ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে এবং সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। এসব অভিযোগের ধারাবাহিকতায় তিনি বলেন, ভারত যদি বাংলাদেশবিরোধী শক্তিকে আশ্রয়–প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ না করে, তাহলে বাংলাদেশও ভারতের সেপারেটিস্টদের আশ্রয় দিয়ে সেভেন সিস্টার্সকে আলাদা করে দেবে। বক্তব্যের এই অংশই মূলত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
এই বক্তব্যের সময় মঞ্চে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপস্থিতি বিষয়টিকে আরও জটিল করে তোলে। ফলে প্রশ্ন ওঠে, এটি কি কেবল একজন নেতার ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও রাজনৈতিক ভাষণ, নাকি নতুন দল এনসিপির বৃহত্তর রাজনৈতিক অবস্থানের ইঙ্গিত। দ্রুতই এনসিপি আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্য তার ব্যক্তিগত উপলব্ধি, দলীয় নীতির প্রতিফলন নয়। দলটি দাবি করে, তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও সীমানার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। একই সঙ্গে তারা ভারতের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অভিযোগের তালিকাও তুলে ধরে, যা দেখায় যে দলীয় অবস্থান পুরোপুরি নরম বা আপসহীন—দুটোর কোনোটিই নয়, বরং দ্বন্দ্বপূর্ণ।
ভারতের প্রতিক্রিয়া আসে কড়া ভাষায়। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, বাংলাদেশের নেতারা যদি ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর–পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দিতে থাকেন, তাহলে দিল্লি চুপ করে থাকবে না। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বক্তব্যকে ‘ভুল চিন্তাধারা’ আখ্যা দেন এবং ভারত একটি পরমাণু শক্তিধর ও বড় অর্থনীতির দেশ—এই বাস্তবতার কথাও স্মরণ করিয়ে দেন। তার বক্তব্যে কেবল প্রতিরোধের হুমকি নয়, বরং বাংলাদেশের প্রতি ভবিষ্যৎ সহযোগিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়, যা কূটনৈতিক ভাষায় একটি স্পষ্ট বার্তা।
এই বক্তব্য–পাল্টা বক্তব্যের মধ্যেই কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন ঘেরাওয়ের কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাই কমিশনারকে তলব করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর আগে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকেও তলব করা হয়েছিল। কূটনীতিতে এসব পদক্ষেপ সাধারণত অসন্তোষ প্রকাশের প্রথাগত উপায় হলেও, একের পর এক তলব পরিস্থিতির উত্তাপকে দৃশ্যমান করে তোলে।
বাংলাদেশ সরকার দ্রুতই নিজেকে এই বক্তব্য থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা স্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে আশ্রয় দেবে না এবং এটি সরকারের অবস্থান নয়। তিনি হাসনাত আব্দুল্লাহকে একজন ‘অ্যাক্টিভিস্ট–রাজনীতিক’ হিসেবে উল্লেখ করে বোঝাতে চান যে রাষ্ট্রীয় নীতি ও রাজনৈতিক বক্তৃতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে সরকার একদিকে ভারতকে আশ্বস্ত করতে চায়, অন্যদিকে দেশের ভেতরের রাজনৈতিক উত্তেজনাকেও সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে।
বিশ্লেষকদের মতে, সেভেন সিস্টার্স ইস্যু ভারতের জন্য নীতিগতভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। উত্তর–পূর্বাঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা, বিদ্রোহ ও নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের সঙ্গে জড়িত। এই অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সংযোগ ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত সংকীর্ণ করিডরের মাধ্যমে, যা কৌশলগতভাবে সংবেদনশীল। ফলে প্রতিবেশী দেশের কোনো নেতার মুখে এই অঞ্চল বিচ্ছিন্ন করার হুমকি ভারতের নিরাপত্তা ভাবনায় সরাসরি আঘাত করে।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে গিয়ে সেভেন সিস্টার্সকে ল্যান্ডলকড উল্লেখ করে বলেছিলেন, সমুদ্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেসময়ও হিমন্ত বিশ্ব শর্মা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের নিজস্ব ‘চিকেনস নেক’ থাকার কথা উল্লেখ করে পাল্টা বার্তা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ এই অঞ্চল নিয়ে মন্তব্য নতুন নয়, তবে হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্যের ভাষা ও হুমকির মাত্রা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিক থেকেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলা এবং হামলাকারীর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার গুজব সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ভারতবিরোধী আবেগ নতুন করে মাথাচাড়া দেয়। এই আবেগ রাজনৈতিক মঞ্চে ভাষা পায়, যেখানে ভারতকে প্রায়শই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পেছনের শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্য সেই আবেগেরই চূড়ান্ত রূপ, যেখানে কূটনৈতিক ভাষার বদলে প্রতিশোধের হুমকি উচ্চারিত হয়।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এ ধরনের বক্তব্য বাস্তবে কতটা প্রভাব ফেলে। সাবেক কূটনীতিকদের মতে, অনেক সময় রাজনৈতিক বক্তৃতায় কথার কথা বলা হলেও সেগুলোর রেশ থেকে যায় এবং তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে যখন বিষয়টি নীতিগতভাবে স্পর্শকাতর হয়, তখন প্রতিক্রিয়া আসবেই। এই ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিক্রিয়া তারই উদাহরণ।
এই বিতর্ক বাংলাদেশের জন্যও একটি সতর্কবার্তা বহন করে। একদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তিগুলো যখন প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষা ব্যবহার করে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে, অন্যদিকে রাষ্ট্রকে সেই বক্তব্যের কূটনৈতিক পরিণতি সামাল দিতে হয়। সরকার যদি স্পষ্টভাবে অবস্থান না নেয়, তাহলে আন্তর্জাতিক মহলে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। আবার অতিরিক্ত দূরত্ব তৈরি করলে দেশের ভেতরে রাজনৈতিক চাপ বাড়তে পারে।
ভারতের দিক থেকেও বিষয়টি কেবল নিরাপত্তার নয়, বরং প্রতিবেশী সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী—ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সব দিক থেকেই। সম্পর্কের অবনতি হলে তার প্রভাব পড়বে বাণিজ্য, যোগাযোগ, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক সহযোগিতায়। ফলে দিল্লির কড়া প্রতিক্রিয়ার আড়ালে একটি বার্তাও আছে—এই ধরনের বক্তব্য সহ্য করা হবে না, কিন্তু একই সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ভেঙে ফেলাও কারও স্বার্থে নয়।
শেষ পর্যন্ত হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্য হয়তো কোনো নীতিগত পরিবর্তন আনবে না, কিন্তু এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক এখন এমন এক পর্যায়ে রয়েছে, যেখানে একটি বক্তব্য, একটি বাক্য বা একটি রাজনৈতিক স্লোগানও বড় কূটনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠতে পারে। এই বাস্তবতায় দুই দেশকেই ভাষা ও আচরণে আরও সংযত হতে হবে, নইলে উত্তেজনার এই ফাটল ধীরে ধীরে আরও গভীর হয়ে উঠতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ