ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক গভীর ধাক্কা। একটি ব্যক্তি নয়, বরং একটি প্রতীকী কণ্ঠ, একটি আন্দোলনের ভাষা, একটি প্রজন্মের ক্ষোভ ও প্রত্যাশার বহিঃপ্রকাশ যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার শেষ নিঃশ্বাস কেবল একটি হত্যাকাণ্ডের পরিসমাপ্তি নয়, এটি রাজনীতির ভেতরে সহিংসতার দীর্ঘ ছায়া, ভয়ের সংস্কৃতি এবং মতপ্রকাশের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিল। হাদির মৃত্যু এমন এক সময়ে এলো, যখন দেশ নির্বাচনমুখী, রাজনীতি উত্তপ্ত, এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি জনগণের আস্থা নড়বড়ে।
হাদি ছিলেন এমন একজন রাজনৈতিক মুখপাত্র, যিনি মূলধারার রাজনীতির বাইরে থেকেও স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেন। ইনকিলাব মঞ্চ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল একটি প্রতিবাদী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে, যেখানে তরুণদের ক্ষোভ, সামাজিক বৈষম্য, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও রাজনৈতিক জবাবদিহির প্রশ্নগুলো উঠে আসত। হাদির বক্তব্য অনেকের কাছে বিতর্কিত ছিল, আবার অনেকের কাছে ছিল সাহসী ও সময়োপযোগী। তিনি ছিলেন এমন একজন যিনি ভয়কে উপেক্ষা করে কথা বলতেন—এবং শেষ পর্যন্ত সেই ভয়ই যেন তাকে গ্রাস করল।
পুরানা পল্টনের বক্স-কালভার্ট রোডে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা, তারপর দীর্ঘ চিকিৎসা, অবশেষে বিদেশের হাসপাতালে মৃত্যু—এই পুরো ঘটনাপ্রবাহ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার ভয়াবহতা নগ্ন করে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, একজন পরিচিত রাজনৈতিক মুখপাত্র যদি রাজধানীর কেন্দ্রে এমন হামলার শিকার হন, তাহলে সাধারণ নাগরিক কতটা নিরাপদ? এই প্রশ্ন কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নয়, গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।
হাদির মৃত্যুতে রাজনীতিতে যে প্রভাব পড়বে, তা বহুস্তরীয়। প্রথমত, এটি বিরোধী ও প্রতিবাদী রাজনীতির কণ্ঠকে আরও সতর্ক কিংবা আরও র্যাডিক্যাল করে তুলতে পারে। ইতিহাস বলে, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কখনো আন্দোলন থামায় না, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা আরও তীব্র করে তোলে। হাদির মৃত্যু ইনকিলাব মঞ্চকে হয়তো সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করবে, কিন্তু আদর্শিকভাবে এটি তাদের জন্য একটি ‘মার্টার ন্যারেটিভ’ তৈরি করতে পারে। এই ন্যারেটিভ তরুণদের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভ ও প্রতিরোধের চেতনা জাগাতে পারে, যা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়াবে।
দ্বিতীয়ত, এই মৃত্যু মূলধারার রাজনীতির জন্যও অস্বস্তিকর। ক্ষমতাসীন পক্ষ হোক বা বিরোধী দল—সবাই এখন চাপের মুখে। কারণ সহিংস রাজনীতির দায় শেষ পর্যন্ত পুরো রাজনৈতিক শ্রেণির ওপরই পড়ে। নির্বাচন সামনে রেখে সরকারকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম, অন্যদিকে বিরোধীরা এই ঘটনাকে ব্যবহার করবে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার উদাহরণ হিসেবে। ফলে হাদির মৃত্যু একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হবে, যা নির্বাচনী বক্তৃতা, বিবৃতি ও প্রচারণায় বারবার ফিরে আসবে।
তৃতীয়ত, এই ঘটনা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক মত প্রকাশ বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই ঝুঁকি আরও বেড়েছে। হাদির মতো একজন মুখপাত্র, যিনি নিয়মিত প্রকাশ্যে কথা বলতেন, তার ওপর এমন হামলা অন্য অনেক কণ্ঠকে নীরব করে দিতে পারে। সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট, ছাত্রনেতা—অনেকে হয়তো নতুন করে ভাববেন, কথা বলার মূল্য কতটা চড়া হতে পারে। এই ভয় যদি সমাজে গেঁথে যায়, তাহলে তা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে হাদির মৃত্যু আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এনেছে—রাজনীতিতে সহিংসতা কি আবার ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠছে? নির্বাচন এলেই সংঘর্ষ, হামলা, হত্যা—এগুলো যেন এক ধরনের পূর্বানুমেয় চিত্র। হাদির হত্যাকাণ্ড সেই চক্রেরই অংশ কি না, নাকি এটি একটি বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনা—এই প্রশ্নের উত্তর এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু জনমনে যে ধারণা তৈরি হচ্ছে, তা হলো রাজনীতি মানেই ঝুঁকি, রাজনীতি মানেই প্রাণহানির আশঙ্কা। এই ধারণা ভোটারদের অংশগ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
আরেকটি দিক হলো আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট। হাদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো যায়নি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই ঘটনার দিকে নজর দিতে পারে, বিশেষ করে যদি তদন্ত প্রক্রিয়া স্বচ্ছ না হয়। নির্বাচনকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও চাপ এমনিতেই বাড়ে, তার ওপর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
হাদির ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনৈতিক পরিচয়ও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কোনো বড় দলের শীর্ষ নেতা ছিলেন না, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর পৌঁছাত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, জনসভা, প্রতিবাদ—সব জায়গায় তিনি ছিলেন দৃশ্যমান। এই দৃশ্যমানতাই তাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে কি না, সেটিও ভাবনার বিষয়। এটি দেখায় যে আধুনিক রাজনীতিতে প্রভাব শুধু পদ বা দলের আকার দিয়ে মাপা হয় না, বরং কণ্ঠের জোর ও বার্তার বিস্তার দিয়েও হয়। হাদির মৃত্যু সেই বাস্তবতাকে নির্মমভাবে সামনে এনেছে।
ভবিষ্যতের রাজনীতিতে এর প্রভাব কেমন হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করবে রাষ্ট্র কীভাবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করে। যদি দ্রুত, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হয়, অপরাধীরা শাস্তি পায়, তাহলে এটি অন্তত একটি বার্তা দেবে যে সহিংসতার জায়গা নেই। কিন্তু যদি ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়, তদন্ত ঝুলে থাকে, তাহলে তা আরও অবিশ্বাস, আরও ক্ষোভ তৈরি করবে। সেই ক্ষোভ নির্বাচনের সময় বিস্ফোরিত হতে পারে।
হাদির মৃত্যু এক অর্থে বাংলাদেশের রাজনীতির আয়না। এই আয়নায় দেখা যায় সাহসী কণ্ঠের ঝুঁকি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক সহনশীলতার অভাব এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সংকট। নির্বাচন সামনে রেখে এই আয়নায় তাকানো খুব জরুরি। কারণ যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না খোঁজা হয়, তাহলে হাদির মৃত্যু শুধু একটি খবর হয়েই থাকবে না, বরং ভবিষ্যতে আরও অনেক হাদির জন্য পথ খুলে দেবে।
শেষ পর্যন্ত হাদি থাকবেন স্মৃতিতে—কারও কাছে নায়ক, কারও কাছে বিতর্কিত মুখ, আবার কারও কাছে নিপীড়নের শিকার এক তরুণ কণ্ঠ। কিন্তু তার মৃত্যু যে প্রশ্নগুলো রেখে গেল, সেগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। নির্বাচন কেবল ক্ষমতা বদলের প্রক্রিয়া নয়, এটি রাষ্ট্র ও সমাজের মূল্যবোধেরও পরীক্ষা। হাদির মৃত্যুর পর সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।
আপনার মতামত জানানঃ