ঠিক এক বছর আগে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক পালাবদল। এটি ছিল সেই দিন, যেদিন হাজারো সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং পেশাজীবীরা রাজপথে নেমে এসে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেন। কিন্তু এক বছর পর, আজ ২০২৫ সালের ৫ আগস্টে দাঁড়িয়ে, সেই বিপ্লব কি আদৌ বেঁচে আছে? নাকি কালের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে এক সোনালি স্বপ্ন?
সিনথিয়া মেহরিন সকালের মতো শিক্ষার্থীরা এখনও ভুলতে পারেন না সেই রক্তাক্ত দিনগুলোর কথা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের অপরাধে যেভাবে তার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল, তার চেয়েও বড় ক্ষত ছিল রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা। রাষ্ট্র নিজেই যেদিন নিজের সন্তানের রক্তে রঞ্জিত হয়, সেদিনই তো শুরু হয় একটি সরকারের পতনের সূচনা।
আবু সাইদের বুকে গুলি করা সেই মুহূর্তটি আজও স্মৃতিতে ভেসে আসে। দুই হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণ, যেন বলছিলেন—“আমি নিরস্ত্র, আমি তোমার ভাই, আমাকে গুলি করো না।” অথচ গুলিই তো করা হয়েছিল। সেদিনের সেই ভিডিও শুধু ভাইরাল হয়নি, তা হয়ে উঠেছিল দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে আঘাত হানা এক বিবেকের ঘণ্টাধ্বনি।
পরবর্তী দিনগুলোতে সারা দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি গ্রামের শিক্ষার্থীরাও নেমে আসে রাস্তায়। তাদের সঙ্গে যোগ দেন শিক্ষক, অভিভাবক, দিনমজুর, দোকানি—যার যার জায়গা থেকে সকলেই এক আওয়াজে বলেছিলেন, “আর না।” তখনকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, এমনকি আদর্শগতভাবে বিপরীতমুখী বিএনপি ও জামায়াত পর্যন্ত এক কাতারে এসে দাঁড়ায়।
এই আন্দোলনের ফলে এক সময়ের সর্বময় ক্ষমতাধর নেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ইতিহাসের এই মুহূর্তটি যেন শুধুই রাজনৈতিক পালাবদল নয়, এটি ছিল এক সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রজন্মগত বিবর্তন। কিন্তু এখন, এক বছর পর, সেই বিবর্তনের গতিপথ নিয়েই তৈরি হয়েছে প্রশ্ন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে থাকা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুরুতে আশার বাতিঘর হয়ে উঠলেও সময়ের সঙ্গে সেই আলো ম্লান হতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক বিভাজন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস—সব মিলিয়ে আন্দোলনের সেই প্রথম যৌক্তিকতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
যে মায়েরা সন্তান হারিয়েছেন, তারা আজও জানতে চান—“আমার সন্তানের মৃত্যু কি শুধুই পরিসংখ্যানের একটি সংখ্যা হয়ে থাকবে?” সানজিদা খান দীপ্তির মতো অনেকেই হতাশ, আর এই হতাশা জন্ম দেয় ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাসের।
অন্যদিকে, আতিকুল গাজীর মতো কেউ কেউ আজও আশাবাদী। যারা জীবনের এক অংশ হারিয়েও বলেন, “আরও একবার প্রয়োজনে আমি জীবন উৎসর্গ করব।” তারাই হয়তো এই দেশের ভবিষ্যতের সম্ভাবনার শেষ রেখা।
কিন্তু আশার বিপরীতে ভয়াবহ বাস্তবতাও আছে। সহিংসতা বেড়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, এবং সামরিক বাহিনী এখন রাস্তায় ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার’ নামে অতি সক্রিয়। আবারো দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চায়, কেউ কেউ সেটি দখল করতে চায়।
রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে আবারো অস্থিরতা বাড়বে—এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা। যদিও ইউনূস সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে সংস্কারের চেষ্টা করছে, বাস্তবে এখনো কমিশনের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব, ভিন্নমত ও সমঝোতার ঘাটতি চোখে পড়ছে।
এরই মধ্যে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি যেমন দেখা যাচ্ছে—রিজার্ভ বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে—তেমনি রাজনৈতিক কাঠামো ও আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে এখনো রয়েছে বহু কাঁটা।
তবুও ইতিহাস জানে, প্রতিটি বিপ্লবের পর আসে চ্যালেঞ্জ। প্রতিটি পরিবর্তনের পরেই তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। আর সেই অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই এক নতুন বাস্তবতা গড়ে উঠতে থাকে।
প্রশ্ন হলো—সেই বাস্তবতাটি কী রকম হবে? তা কি হবে এক গণতান্ত্রিক, ন্যায্য, মানবিক বাংলাদেশ? নাকি আবারো চেনা চক্রে ঘুরতে থাকবে ক্ষমতার খেলা?
এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। কিন্তু সিনথিয়ার সেলাইয়ের দাগ, আবু সাইদের গুলিবিদ্ধ বুক, আনাসের রক্তাক্ত শরীর, খোকনের বিকৃত মুখ অথবা আতিকুলের এক হাতে তোলা হাস্যোজ্জ্বল সেলফি—এসব সাক্ষ্য হয়ে থেকে যাবে ইতিহাসের পাতায়। এটাই হয়তো একদিন বলে দেবে, সেই স্বপ্ন মরেনি, সেটা শুধু অপেক্ষা করছে বাস্তব হবার জন্য।
আপনার মতামত জানানঃ