
ঢাকায় মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর শহরের পরিবহন ব্যবস্থায় এক নতুন ধারা সূচিত হয়েছে। ব্যস্ততম নগরীতে এটি এনে দিয়েছে দ্রুত, নির্ভরযোগ্য এবং তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক যাতায়াতের সুযোগ। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ মেট্রোরেলে চলাচল করছে। যাত্রীদের চাপ এতটাই বেশি যে পিক আওয়ারে অনেকেই প্রথম ট্রেনেই উঠতে পারেন না। কিন্তু অবাক করার মতো বাস্তবতা হলো—এই বিপুল যাত্রীচাপ সত্ত্বেও মেট্রোরেলের আয় দিয়ে এর নির্মাণ ব্যয় বা ঋণ পরিশোধের কিস্তি তোলা যাচ্ছে না। বরং প্রতিনিয়ত বাড়ছে সরকারের ভর্তুকির বোঝা।
বর্তমানে ঢাকায় চালু থাকা এমআরটি-৬ লাইনটি উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বিস্তৃত। দিনে গড়ে প্রায় চার লাখ যাত্রী এই রুটে যাতায়াত করে। কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের কাজ চলছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এমন আরও পাঁচটি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কিছু পাতালরেলও থাকবে, যা ব্যয়ের দিক থেকে হবে আরও চ্যালেঞ্জিং। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—যদি এমআরটি-৬ নিজেই লাভজনক না হয়, তাহলে ভবিষ্যতের এই প্রকল্পগুলোর অর্থনৈতিক টিকে থাকা কীভাবে নিশ্চিত হবে?
প্রকল্প বিশ্লেষণ বলছে, গত অর্থবছরে মেট্রোরেলের টিকিট বিক্রি থেকে আয় হয়েছে আনুমানিক ৪০০ কোটি টাকা। অথচ শুধু ঋণের কিস্তি পরিশোধেই আগামী বছর থেকে বছরে দিতে হবে ৪৬৫ থেকে ৭৪০ কোটি টাকা পর্যন্ত। এই ব্যয় কেবল মূলধনী ঋণের অংশ—এতে রক্ষণাবেক্ষণ, লোকবল, বিদ্যুৎ, প্রশাসনিক খরচ ইত্যাদি ধরা হয়নি। প্রথমদিকে জাইকার কাছ থেকে নেওয়া ঋণে একটি গ্রেস পিরিয়ড (কিস্তি মুক্ত সময়কাল) ছিল ১০ বছর। সেটি শেষ হয়ে যাওয়ার পর ২০২৩ সাল থেকে সীমিত আকারে কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। ২০২৬ সাল থেকে সেই কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যাবে কয়েক গুণ।
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সরকারকে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হবে। ভাড়ার হার বাড়ানো আপাতত সম্ভব নয়, কারণ ঢাকার মেট্রোরেলের ভাড়া ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। জনবহুল একটি দেশে, যেখানে মানুষের আয় তুলনামূলকভাবে কম, সেখানে ভাড়া বাড়ানো জনরোষের কারণ হতে পারে। সরকার এই বিষয়টি বুঝেই এখন পর্যন্ত ভ্যাট মওকুফ রেখেছে। কিন্তু তাতেও লাভজনক অবস্থানে পৌঁছানো যায়নি।
তবে সব দিকেই যে অন্ধকার—তা নয়। মেট্রোরেলের আয় বাড়ানোর কিছু সম্ভাব্য পথ রয়েছে। যেমন, স্টেশনসংলগ্ন জমিতে দোকান বরাদ্দ দিয়ে বাণিজ্যিক ভাড়া আদায়, স্টেশনে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা, বিজ্ঞাপন রাজস্ব, ট্রেন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং দীর্ঘ সময় ধরে ট্রেন চালানোর মাধ্যমে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন। বর্তমানে রাত ১০টার পর ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়, যা অনেক যাত্রীর জন্য অসুবিধাজনক। সেই সময়সীমা বাড়ানো গেলে যাত্রীসংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ডিএমটিসিএল-এর (ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেছেন, পরিচালনা ব্যয় কমাতে অপ্রয়োজনীয় খরচ হ্রাস, নতুন লোকবল নিয়োগ এবং স্টেশনগুলোর অব্যবহৃত জায়গা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সেসব প্রচেষ্টার ফল এখনো স্পষ্ট নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে আরও পাঁচটি মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়া মানে ভবিষ্যতের জন্য বিপুল ঋণের বোঝা কাঁধে তুলে নেওয়া। এমআরটি-৬ নির্মাণে জাইকার কাছ থেকে পাঁচ দফায় প্রায় ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, যা আগামী ৩০ বছরে সুদসহ ফেরত দিতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার দর বাড়লে এই কিস্তির পরিমাণও বাড়বে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন প্রকল্পগুলোর ব্যয় হবে এমআরটি-৬-এর চেয়েও কয়েক গুণ বেশি। কারণ, অনেকগুলো প্রকল্প পাতালপথে নির্মাণ হবে, যার ব্যয় বহুগুণ বেশি। এতে ভবিষ্যতে সরকারের ওপর ভর্তুকির চাপ আরও বাড়বে।
এছাড়া অধ্যাপক সামছুল হকের মতে, মেট্রোরেলের চলমান এমআরটি-৬ লাইনটি ঢাকা শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকার মধ্য দিয়ে গেছে, যার কারণে যাত্রীর চাপ অনেক বেশি। অন্যদিকে নতুন যে মেট্রোরেল লাইনগুলো নির্মিত হবে, সেখানে এই পরিমাণ যাত্রী পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। ফলে আয়ের ঘাটতি আরও প্রকট হবে।
এরপরও সরকার প্রকল্প সম্প্রসারণে আগ্রহী। হয়তো রাজনৈতিক আকর্ষণ এবং আন্তর্জাতিক ঋণপ্রাপ্তির সুবিধার কারণে এরকম উচ্চ ব্যয়বহুল প্রকল্পে সরকার বারবার হাত দিচ্ছে। কিন্তু এই প্রকল্পগুলো দীর্ঘমেয়াদে কতটা টেকসই হবে, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
এই প্রকল্পের বড় একটি সমস্যা হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়। এখন পর্যন্ত এই কাজ করছে নির্মাণ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, কিন্তু আগামী বছর থেকে সেটির দায়িত্ব ডিএমটিসিএল-এর ওপর বর্তাবে। এতে করে পরিচালন ব্যয় এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। বিদ্যুৎ, যন্ত্রপাতি, কর্মী বেতন সব মিলিয়ে প্রতিবছর কয়েকশ কোটি টাকার খরচ বাড়বে। অথচ আয় বাড়ানোর যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা এখনও প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। যেমন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মেট্রোরেলের আয় ছিল মাত্র ২২ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৪৪ কোটি। ২০২৪-২৫ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকায়। কিন্তু ঋণের কিস্তি ও পরিচালন ব্যয় হিসাব করলে দেখা যায়, আয় দ্বিগুণ হলেও ঘাটতি রয়েই যাচ্ছে।
সাধারণ যাত্রীরা মনে করেন, ট্রেনের সংখ্যা এবং চলাচলের সময় যদি বাড়ানো যায়, তাহলে মেট্রোরেলের জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে এবং সেখান থেকে আয়ও বাড়বে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—সেই অতিরিক্ত পরিচালন খরচ সামলাতে কি আয় যথেষ্ট হবে?
বিপুল ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে কোনো একটি রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের লাভজনকতা বিচার করতে হয় একাধিক দিক বিবেচনা করে। শুধু টিকিট বিক্রি দিয়ে পুরো ঋণ শোধ সম্ভব নয়—এটা অনেক দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু বাংলাদেশে সমস্যা হলো, সরকারের অন্যান্য খাতেও বিশাল ভর্তুকি দিতে হয়—বিদ্যুৎ, খাদ্য, কৃষি, তেল। সেখানে নতুনভাবে মেট্রোরেলের ভর্তুকি চাপ বাড়াতে পারে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যে।
ভবিষ্যতের মেট্রোরেল প্রকল্পগুলোর স্থায়িত্ব নির্ভর করবে এ বিষয়গুলোর উপর:কতটা খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায় কি না, বাণিজ্যিকভাবে স্টেশন ব্যবহার করা যায় কি না, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে কি দেশীয় উৎস থেকে অর্থায়ন সম্ভব?
প্রকল্প পরিচালনায় স্বচ্ছতা, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও আয়ের নতুন উৎস খুঁজে বের করা ছাড়া বিকল্প নেই। অন্যথায়, ঢাকার প্রাণের মেট্রোরেল একসময় দেশের অর্থনীতির গলায় ফাঁস হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ