ঢাকা শহর আজ এক অদৃশ্য মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। সকালবেলায় অফিসগামী মানুষটি জানে না, ফেরার সময় তার জীবনের গন্তব্য কোথায় শেষ হবে। কেউ ময়লার গাড়ির ধাক্কায়, কেউ ইট পড়ায়, কেউ ফ্লাইওভারের নিচে চাপা পড়ে, আবার কেউ মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাডের নিচে নিথর হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের রাজধানী এখন এমন এক শহর, যেখানে মৃত্যু আসে অপ্রত্যাশিতভাবে, কখনও আকাশ থেকে, কখনও সড়ক থেকে, আবার কখনও রাষ্ট্রের অবহেলা থেকে। উত্তরার গার্ডারপতনের তিন বছর পর ফার্মগেটের ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে মারা যাওয়া আবুল কালামের ঘটনাটি যেন আরেকটি প্রতীক—এই নগরে কারও জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সোমবার সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে মতিঝিলে কাজে এসেছিলেন আবুল কালাম। এরপর ফার্মগেট এলাকায় হাঁটছিলেন ফুটপাত ধরে। হঠাৎ মেট্রোরেলের পিলার থেকে খুলে পড়ে বিয়ারিং প্যাড—এক মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায় তার জীবন। দু’টি সন্তানের বাবা, পরিবারের সবার ছোট, জীবনের প্রতিদিনের লড়াই করা একজন মানুষ, যার মৃত্যু এখন শহরের আরেকটি পরিসংখ্যান মাত্র। তার ছবিটি ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে, সঙ্গে ক্ষোভ, হতাশা ও এক অনিবার্য প্রশ্ন—এই শহরে কে বাঁচবে, কে মরবে, সেটা কি ভাগ্য ঠিক করে নাকি ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা?
ঢাকার ইতিহাস খুললে দেখা যায়, এমন মৃত্যুর দৃশ্যগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০২২ সালে উত্তরার ব্যস্ত সড়কে ফ্লাইওভারের গার্ডার তুলতে গিয়ে ক্রেন ভেঙে পড়েছিল চলন্ত প্রাইভেটকারের ওপর। মুহূর্তেই প্রাণ হারায় এক নবদম্পতি ও আরও তিনজন। শহরজুড়ে প্রতিবাদ, ক্ষোভ, টেলিভিশনে আলোচনা—কিন্তু কয়েকদিন পরই সব চুপ। তদন্ত কমিটি হয়, ক্ষতিপূরণের ঘোষণা আসে, তারপর ভুলে যাওয়া হয় নামগুলো। ঠিক একইভাবে, ব্যাংক কর্মকর্তা দীপান্বিতা বিশ্বাস দীপুর মৃত্যুও এই শহরের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল। মগবাজারের ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে তার মাথায় ওপর থেকে ইট পড়ে, আর সেখানেই জীবন থেমে যায়। সামাজিক মাধ্যমে তার শেষ মুহূর্তের ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, কিন্তু বিচার বা প্রতিরোধের কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা হয়নি।
এমন মৃত্যুগুলো এখন যেন শহরের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। ঢাকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মানুষ মনে মনে প্রস্তুতি নেয়—কোনো অটোরিকশা ফুটপাথে উঠে পড়বে কি না, কোনো ময়লার গাড়ি পেছন থেকে ধাক্কা দেবে কি না, কোনো নির্মাণাধীন ভবন থেকে কিছু পড়বে কি না। ভয়টা এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আতঙ্কটাই জীবনের স্থায়ী সঙ্গী। আমিনুল ইসলাম প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার পথে মোহাম্মদপুর থেকে উত্তরা যান। তিনি বললেন, “সবসময় একটা ভয় কাজ করে—কোথায় কী ভেঙে পড়বে কে জানে। এভাবে কি বাঁচা যায়?” বাজারে যাওয়া মানুষও এখন মাথা উঁচু করে হাঁটে না, চোখ রাখে ওপরের দিকে, যদি কিছু পড়ে আসে!
সমাজ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, “ঢাকা এখন মানুষের জন্য নয়, এক মৃত্যু ফাঁদের শহর। এখানে কারও জীবনের নিশ্চয়তা নেই, কোনো জায়গাই নিরাপদ নয়। মৃত্যু আসে অবহেলা থেকে, প্রশাসনিক ব্যর্থতা থেকে, এক ধরনের নৈরাজ্য থেকে।” তার মতে, প্রতিটি এমন ঘটনার পেছনে আছে দায়িত্বে অবহেলা, কিন্তু কখনোই তার বিচার হয় না। “যখন কেউ মারা যায়, তখন বলা হয় দুর্ঘটনা। কিন্তু এগুলো দুর্ঘটনা নয়—এগুলো হত্যাকাণ্ড। কারণ যে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে মৃত্যু ঘটছে, তা জানার পরও কেউ ব্যবস্থা নেয় না।”
স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিবও মনে করেন, শহরের মৃত্যুর এই ধারাবাহিকতা কোনো প্রাকৃতিক পরিণতি নয়। “ফ্লাইওভার থেকে নাটবল্টু খুলে নেওয়া হচ্ছে দিবালোকে, কেউ কিছু বলছে না। কেউ শাস্তি পাচ্ছে না। অথচ যে প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব অনুমোদন ও তদারকি করা, তারা নীরব। এটা অবহেলা নয়, এটা অপরাধ।” তার ভাষায়, ঢাকার প্রতিটি কোণ আজ ‘গভর্নেন্সের মৃত্যু’র প্রতীক।
অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোনো মৃত্যুই এখন আর বিস্ময় সৃষ্টি করে না। মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে, পোস্ট দেয়, মন্তব্যে দুঃখ ঝরে, তারপর চলে যায় পরবর্তী খবরের দিকে। মৃত্যু এখানে যেন এক সংবাদচক্রের উপকরণ, সাময়িক আবেগের বস্তু। অথচ প্রতিটি মৃত মানুষ ছিল কারও সন্তান, কারও স্বামী, কারও বাবা বা বন্ধু। আবুল কালামের সন্তানেরা হয়তো এখনো বুঝে উঠতে পারেনি কেন তাদের বাবা এক সকালে বেরিয়ে আর ফিরে এলেন না।
ঢাকা শহরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন দ্রুত হয়েছে, তেমনি বেড়েছে তার ঝুঁকিও। প্রতিদিন নতুন সড়ক, নতুন সেতু, নতুন নির্মাণকাজ—কিন্তু সেই উন্নয়নের নিরাপত্তা কাঠামো কই? প্রতিটি বড় প্রকল্পের চারপাশে কোনো সুরক্ষা বলয় নেই, নির্মাণ এলাকায় সাইনবোর্ড থাকে না, পথচারীর সুরক্ষা নিয়ে কেউ ভাবে না। তবু উন্নয়নের গতি অব্যাহত, কারণ উন্নয়ন মানে এখন সংখ্যায় অর্জন, জীবনে নয়। একটি শহরকে আধুনিক বলা হয় যখন তার মানুষ নিরাপদে বাঁচে, কিন্তু ঢাকায় উন্নয়ন মানে এখন শুধু কংক্রিটের সংখ্যা আর লোহার খাঁচা।
সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ এই বাস্তবতাকে ব্যঙ্গ করে লিখেছেন—“এই শহরে মানুষের জীবন সবচেয়ে সস্তা।” কেউ আবার বলেন, “ঢাকায় এখন মৃত্যুরও রুটিন আছে, শুধু দিন-সময়টা জানি না।” এমন মন্তব্য নিছক আবেগ নয়, বরং দীর্ঘদিনের এক নিরাশার বহিঃপ্রকাশ। কারণ মানুষ দেখেছে, একের পর এক প্রাণহানির পরও অপরাধীরা অধরাই থাকে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা দুঃখ প্রকাশ করে, তদন্ত কমিটি হয়, কয়েকদিন পর ফলাফল কেউ জানে না। ক্ষতিপূরণের ঘোষণায় সমাধান হয়ে যায় একটি জীবনহানির মূল্য।
এই অনিশ্চয়তার শহরে রাষ্ট্রের ভূমিকা তাই প্রশ্নের মুখে। নাগরিক নিরাপত্তা এখন আর কেবল অপরাধপ্রবণতা দিয়ে মাপা যায় না; এটি অবকাঠামোর, ব্যবস্থাপনার, এবং নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন। যখন প্রশাসন জানে কোনো নির্মাণ সাইটে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই, তবু কাজ চলছে, তখন প্রতিটি শ্রমিক বা পথচারীর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। তবু কাজ থামে না, কারণ সময়মতো প্রকল্প শেষ করলেই প্রাপ্তি, নিরাপত্তা নয়। ঠিক এখানেই শুরু হয় ‘দায়িত্বহীনতার রাজনীতি’।
এমন এক বাস্তবতায় বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে শহরভীতি জন্ম নিচ্ছে। তারা দেখে, এই শহরে কেউ মৃত্যুর কারণ খুঁজতে চায় না, শুধু সময় কাটিয়ে দিতে চায়। অথচ ঢাকাই একসময় ছিল জীবিকার শহর, স্বপ্নের জায়গা। গ্রাম থেকে মানুষ এসেছিল কাজের খোঁজে, শিক্ষার সুযোগে, উন্নত জীবনের আশায়। কিন্তু এখন ঢাকায় বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। শহরের বায়ু বিষাক্ত, পানি দূষিত, যানজট অসহনীয়, তার ওপর মৃত্যু সর্বদা সম্ভাবনা হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
যারা প্রতিদিন এই শহরে রিকশা চালায়, রাস্তা পার হয়, নির্মাণস্থলে কাজ করে—তারা জানে, তাদের মৃত্যুর খবর হয়তো একদিনের বেশি টিকে থাকবে না। টেলিভিশনের স্ক্রলে চলে আসবে অন্য খবর, অন্য মৃত্যু। এভাবেই ঢাকায় মৃত্যুর সাথে সহাবস্থানই এখন বাস্তবতা। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, যখন একটি সমাজে মৃত্যু সাধারণ হয়ে যায়, তখন সেই সমাজ জীবনের মূল্য হারিয়ে ফেলে। ঢাকায় সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বহু আগেই।
তবু মানুষ এই শহর ছাড়ে না। কারণ কাজ, রুটি, শিক্ষা, চিকিৎসা—সবকিছুই এখানে কেন্দ্রীভূত। তাই তারা ঝুঁকি মেনেই বেঁচে থাকে। প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে ভাবে, হয়তো আজ কিছু হবে না। আর সন্ধ্যায় ফেরে, জীবিত থাকার স্বস্তি নিয়ে। এই স্বস্তি কোনো আনন্দ নয়, বরং বেঁচে থাকার এক বিষণ্ণ সান্ত্বনা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব যেমন বলেছেন, “যাদের অবহেলার কারণে এসব ঘটে, তাদের কোনো শাস্তি হয় না বলেই এমনটা চলতেই থাকবে।” অর্থাৎ মৃত্যুফাঁদ বন্ধ হবে না যতদিন না জবাবদিহিতা শুরু হয়। এ শহরের জন্য দরকার একটি সম্পূর্ণ নিরাপত্তা সংস্কৃতি—যেখানে পরিকল্পনা, নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং মানবিক মূল্যবোধ একসাথে কাজ করবে। শুধুমাত্র প্রকল্পের সফলতা নয়, প্রতিটি নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা হবে প্রধান অগ্রাধিকার।
তবে এই সংস্কৃতি গড়ে উঠবে না যতদিন মানুষ মৃত্যুকে স্বাভাবিক ধরে নেবে। শহরটি যেভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর প্রতি উদাস হয়ে উঠছে, সেটিই সবচেয়ে ভয়ংকর। যে সমাজ প্রতিদিনের মৃত্যুতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, সে সমাজের আত্মা মরে যায় নিঃশব্দে। হয়তো তখন আর কোনো আবুল কালামের মৃত্যু সমাজকে নাড়িয়ে দেবে না, বরং মানুষ বলবে—“আবারও একটি দুর্ঘটনা।”
ঢাকায় এখন প্রতিটি ফুটপাত, প্রতিটি ফ্লাইওভার, প্রতিটি নির্মাণসাইটে লুকিয়ে আছে সেই সম্ভাব্য ‘দুর্ঘটনা’। শুধু সময়ের অপেক্ষা, কে পরের শিকার হবে। কেউ জানে না কখন, কোথায়, কাকে মৃত্যু খুঁজে নেবে। হয়তো সেটিই এখন এই শহরের একমাত্র নিশ্চয়তা—অন্যসব অনিশ্চিতের মাঝে মৃত্যুই একমাত্র নিশ্চিত।
আপনার মতামত জানানঃ