রংপুরের গংগাচড়ার সাম্প্রতিক ঘটনাটি বাংলাদেশের বর্তমান ধর্মীয় সহনশীলতা, প্রশাসনিক প্রস্তুতি এবং সংখ্যালঘু নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। একটি সন্দেহভাজন ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে কীভাবে একটি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, এই ঘটনাই তার নির্মম উদাহরণ। বেতগাড়ী ইউনিয়নের এক কিশোরের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মের নবী সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগ ওঠার পরপরই প্রশাসন তাকে গ্রেপ্তার করে এবং সাইবার সুরক্ষা আইনে মামলা দায়ের করে কারাগারে পাঠায়। অথচ প্রশাসনিক এই পদক্ষেপের পরও সহিংসতা ঠেকানো যায়নি। অভিযোগ ওঠে, মাইক ব্যবহার করে উত্তেজনা সৃষ্টি করে হাজারো মানুষকে উসকে দিয়ে হামলা চালানো হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, কিশোরটি নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং তার পরিবার নিজ উদ্যোগেই তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। এমনকি স্থানীয় হিন্দু নেতারা শান্তি বজায় রাখার অনুরোধ জানানোর পরও উত্তেজিত জনতা থেমে থাকেনি। গংগাচড়ার পাশের একটি এলাকা থেকে মিছিলসহ লোকজন এসে হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্তত ১৫-১৬টি বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট এবং ক্ষেতের ফসল ধ্বংস করে দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এই ধরনের ঘটনা শুধু সম্পদের ক্ষতি নয়, বরং একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়, নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়, যা একটি বহুধা সংস্কৃতির রাষ্ট্রে এক মারাত্মক সংকেত।
প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, প্রথম রাতেই কিশোরটিকে হেফাজতে নেয়া হয় এবং পরদিন সকাল থেকে সেনা মোতায়েনসহ নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। কিন্তু রবিবার দুপুরে সেনাবাহিনী সরে যাওয়ার পর আবারও সহিংসতা শুরু হয়। ফলে বোঝা যায়, শুধুমাত্র উপস্থিতি দিয়ে পরিস্থিতি সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও, সামগ্রিকভাবে প্রশাসনিক পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল। থানার ওসি স্বীকার করেছেন, কিশোরের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে, তবে ঘটনাস্থলে থাকা সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, অভিযোগের ভিত্তি হিসেবে যেটি বলা হচ্ছে সেই ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি ভেরিফায়েড নয় এবং প্রকৃতপক্ষে কে পোস্টটি করেছে তাও নিশ্চিত নয়।
এভাবে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই জনতাকে উত্তেজিত করে সহিংসতায় নামিয়ে আনা গভীরভাবে চিন্তার বিষয়। ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক বা সামাজিক স্বার্থে ব্যবহার করার প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের একটি দুঃখজনক বাস্তবতা। ভোলা, নাসিরনগর, কুমিল্লা কিংবা রামুর মতো ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি গংগাচড়ার ঘটনার মধ্য দিয়েও পরিলক্ষিত হয়। এই সহিংসতা একধরনের ‘প্যাটার্ন’ তৈরি করেছে—সামাজিক মাধ্যমে একটি অভিযোগ ছড়ানো, জনতা উত্তেজিত হওয়া, প্রশাসনের ধীর পদক্ষেপ এবং শেষপর্যন্ত একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা।
এই ঘটনাগুলোর মূল সমস্যা হচ্ছে, যেকোনো ধর্মীয় অভিযোগ সত্য হোক বা মিথ্যে, সেটিকে আইনের মাধ্যমে মোকাবেলার পরিবর্তে জনতার হাতে বিচার তুলে দেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়ে গেছে। এটি আইনের শাসনের ওপর আস্থা কমিয়ে দেয় এবং একটি ভয়ংকর নজির স্থাপন করে, যেখানে যে কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু ছড়িয়ে দিয়ে সহিংসতা ঘটাতে পারে। এ ধরনের সংস্কৃতি একটি রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে।
গংগাচড়ার ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও লক্ষণীয়। স্থানীয় জামায়াত নেতা এটিকে সাধারণ মানুষের ‘স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া’ বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও বিএনপি নেতারা প্রশাসনের ব্যর্থতার দিকটি সামনে এনেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, ঘটনাটি কেবল ধর্মীয় আবেগ নয়, বরং রাজনৈতিক হিসাবনিকাশের অংশও হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে যখন দেখা যায় প্রশাসনকে আগেভাগে সতর্ক করার পরও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হয়নি এবং সেনা সরানোর পরপরই আবার হামলা হয়েছে।
এই ঘটনার পর প্রশাসন হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়। অথচ এই দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সহিংসতা চালিয়ে যেতে পারে। ধর্মের নামে উস্কানি, মিথ্যা প্রচার এবং জনতা দিয়ে বিচার চালানো—এই প্রবণতাকে আইন ও সমাজ উভয় পর্যায়ে প্রতিহত না করতে পারলে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
এই ধরনের ঘটনাগুলো শুধু একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নয়, এটি গোটা জাতির জন্য হুমকি। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব, শুধু আইন দিয়ে নয়, সামাজিক সচেতনতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমেও। গংগাচড়া শুধু একটি স্থান নয়, এটি বাংলাদেশের হাজারো ধর্মীয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামের প্রতীক, যারা প্রতিনিয়ত আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা ও চুপ করে থাকার সংস্কৃতির মধ্যে বাস করে।
এখন সময় এসেছে—ধর্মীয় সহিংসতার এই অপসংস্কৃতি রুখে দিতে রাষ্ট্র, প্রশাসন, রাজনীতি ও নাগরিক সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে। না হলে ‘একটি ফেসবুক পোস্ট’ নামক ভয়ংকর অস্ত্র আরও বহুবার বাংলাদেশের সামাজিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেবে।
আপনার মতামত জানানঃ