২০২৪ সালের ৪ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন—এই ১১ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর ঘটেছে প্রায় ২ হাজার ৪৪২টি সহিংসতার ঘটনা। এই পরিসংখ্যান উঠে এসেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এক সংবাদ সম্মেলনে, যা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম মিলনায়তনে। এই বিস্ময়কর তথ্য সামনে আসার পর দেশের গণতান্ত্রিক বাস্তবতা, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং মানবাধিকারের প্রশ্ন আবারও নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে।
ঐক্য পরিষদের নেতারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, এই সহিংসতাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এটি একটি ধারাবাহিক ও পরিকল্পিত নিপীড়নের চিত্র, যা দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকারকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করছে। তারা এই ঘটনার জন্য প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করেছেন।
এই ২,৪৪২টি ঘটনার ভেতরে কী ছিল?
ঐক্য পরিষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই সহিংসতার মধ্যে রয়েছে হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা, ধর্ম অবমাননার অজুহাতে সংখ্যালঘুদের গ্রেপ্তার, জোর করে বাড়ি ও জমি দখল, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর হামলা, চাকরি থেকে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা এবং ধর্মান্তরিত করার হুমকি। সংখ্যালঘুদের ওপর পরিচালিত এসব হামলার বেশিরভাগই থেকে যাচ্ছে প্রশাসনিক তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার বাইরেই।
সংঘবদ্ধভাবে বাড়িঘর দখল, মন্দির বা গির্জা ভাঙচুর, সামাজিকভাবে বয়কটের মতো ঘটনার পাশাপাশি সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে—ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘু কিশোরদেরও পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হচ্ছে। বাস্তবে কোনো প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও, ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে তাদের জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে। এসব ঘটনার পেছনে উসকানিদাতা, দখলদার চক্র কিংবা প্রভাবশালী স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তির সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
সর্বোচ্চ সহিংসতা ঘটেছিল মাত্র ১৭ দিনে
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট—মাত্র ১৭ দিনের ব্যবধানে সংঘটিত হয়েছে ২ হাজার ১০টি সহিংসতার ঘটনা। এই অস্বাভাবিক মাত্রার সহিংসতা ছিল পরিকল্পিত, সময়মাফিক এবং সংঘবদ্ধ। এরপর ২১ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও ১৩২টি এবং ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত নতুন করে আরও ২৫৮টি সহিংসতা ঘটেছে। যদিও সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম, তবু এই ধারা থেমে নেই বলেই মনে করছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
সরকারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত
সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য পরিষদের নেতারা সরকারকে সরাসরি অভিযুক্ত করেন সংখ্যালঘুদের উপর হওয়া সহিংসতাকে উপেক্ষা করার জন্য। তারা বলেন, সরকার সাম্প্রদায়িক হামলাকে রাজনৈতিক ইস্যু বলেই দায়সারা দিচ্ছে। এতে একদিকে যেমন প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে না, অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা ও হতাশা।
সংগঠনের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিও বলেন, “আমরা লক্ষ্য করছি, সংখ্যালঘুদের বাদ দিয়েই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কার্যক্রম শেষ হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক। আমরা এই দেশের নাগরিক, অথচ আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কোনো দায় সরকার নিচ্ছে না।”
ভিন্ন মত প্রকাশ করে সংগঠনের আরেক সভাপতি নিমচন্দ্র ভৌমিক বলেন, “এই দেশের ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধে রক্ত দিয়ে লেখা। সেই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রেই বলা হয়েছে—সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার কথা। আজ যখন সংখ্যালঘুরা মার খায়, ঘর হারায়, তখন এই ঘোষণাপত্রের মূল্য কোথায় থাকে?”
ধর্মীয় উস্কানি ও সামাজিক মিথ্যাচার
বাংলাদেশের গ্রামীণ ও মফস্বল এলাকায় ধর্মীয় উস্কানি এবং গুজব অনেক সময়েই সহিংসতার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা পোস্ট, বা ভুয়া স্ক্রিনশটের মাধ্যমে কাউকে অভিযুক্ত করে জনরোষ তৈরি করা হয়। এই জনরোষ খুব দ্রুতই রূপ নেয় মন্দিরে হামলা, সংখ্যালঘুর বাড়িতে আগুন দেওয়া কিংবা দলবদ্ধ মারধরে। এসব ঘটনার বেশিরভাগেই দেখা যায়—অভিযুক্ত ব্যক্তি নিরপরাধ, পোস্টটি ভুয়া কিংবা অন্য কেউ করেছে।
একটি সাধারণ প্রবণতা হলো—প্রশাসনের দেরি করে ঘটনাস্থলে পৌঁছানো, অথবা উপস্থিত থেকেও হামলা থামানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া। অনেক সময় প্রশাসন ঘটনাকে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ হিসেবে চিহ্নিত করে, ফলে আইনি বিচার তো দূরের কথা, ঘটনার দায়-দায়িত্বই অস্বীকার করা হয়।
রাষ্ট্রীয় নির্লিপ্ততায় দুর্বৃত্তদের সাহস বাড়ছে
অভিযোগ আছে, এই সহিংসতা ঠেকাতে প্রশাসন যেমন উদাসীন, তেমনি সরকারও রাজনৈতিকভাবে এ বিষয়ে নিশ্চুপ। এতে সমাজে এমন একটি বার্তা যাচ্ছে—সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চালিয়ে পার পাওয়া যায়, কোনো শাস্তির ভয় নেই। এই বার্তাই দুর্বৃত্তদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে। রাজনৈতিক নেতাদের প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য, কিংবা স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ও এতে ভূমিকা রাখছে।
সংখ্যালঘুরা ক্রমেই হয়ে পড়ছে অনিরাপদ
শুধু নির্যাতন নয়, এই সহিংসতার কারণে বহু সংখ্যালঘু পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে যাওয়ারও চেষ্টা করছে। এতে একদিকে যেমন সামাজিক ভাঙন তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী দ্রুত কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য, প্রশাসনে প্রতিনিধি না থাকা, এবং আইনি সহায়তার অভাব তাদের আরও বেশি দুর্বল করে দিচ্ছে।
জাতীয় নিরাপত্তা ও গণতন্ত্রের জন্য এটি হুমকি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি রাষ্ট্রে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা না থাকলে সেটি কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা না থাকলে আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়, বিনিয়োগ কমে যায় এবং সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। একে গণতন্ত্রের অবনতি হিসেবেও দেখা হয়।
নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ একাধিকবার সরকারকে অনুরোধ করেছে, যেন এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হয় এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তারা একটি নিরপেক্ষ ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা কমিশন’ গঠনের দাবি জানিয়েছেন, যেখানে সরাসরি অভিযোগ জানানো যাবে এবং দ্রুত প্রতিকার মিলবে।
এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমের সম্মিলিত দায়িত্ব হলো সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানো, সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙা। রাষ্ট্র যদি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হয়, তবে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব তারই।
আপনার মতামত জানানঃ