চট্টগ্রামের রপ্তানিখাত বিশেষ করে পোশাক শিল্প নতুন এক সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কহার তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় দেশটির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে চীন ও ভারতের মতো বড় ক্রেতা দেশগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলো। এর ফলে চট্টগ্রামের ২৫০টিরও বেশি পোশাক কারখানার ওপর আন্তর্জাতিক অর্ডার চাপ বাড়তে শুরু করেছে। তৈরি পোশাক খাতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের শুল্কহার সমান হলেও, চীনের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ এবং ভারতের তুলনায় ৫ শতাংশ কম হওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের জন্য।
বিশেষত, চীনা ক্রেতারা বর্তমানে ‘FOC’ বা ফ্রি অফ কস্ট পদ্ধতিতে অর্ডার দিচ্ছে। এ পদ্ধতিতে তারা নিজস্বভাবে কাপড় ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সামগ্রী পাঠিয়ে দেয় এবং বাংলাদেশে কেবল সেলাই করে পণ্য রপ্তানি করা হয়। এই মডেলটি বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোর জন্য বিশেষভাবে লাভজনক, কারণ এতে কাঁচামাল আমদানির ঝুঁকি ও খরচ কমে আসে। তবে এখানেই রয়েছে বড় এক চ্যালেঞ্জ—জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) এর বন্ড সুবিধা ও অন্যান্য নীতিগত জটিলতা। বর্তমানে এ ধরনের অর্ডারে যে ধরনের আমলাতান্ত্রিক প্যাঁচ দেখা যাচ্ছে, তা সহজ করা গেলে এই বাজার বিস্তারের পথ অনেক বেশি উন্মুক্ত হবে।
ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, রপ্তানির প্রতিটি ধাপে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এখনো বড় বাধা হয়ে আছে। অর্ডার গ্রহণ, পণ্যের অনুমোদন, কাগজপত্র যাচাই ও শুল্ক ছাড়পত্র—সব ক্ষেত্রেই দীর্ঘসূত্রিতা ও অপ্রয়োজনীয় জটিলতা রপ্তানিকারকদের সময় ও অর্থ উভয়ই নষ্ট করছে। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে হলে জরুরি ভিত্তিতে এক্সপোর্ট প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড, সহজ এবং স্বচ্ছ করতে হবে। একই সঙ্গে দরকার স্বল্পসুদে ঋণ এবং উৎপাদন বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি।
এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। শুধু শ্রমনির্ভর নয়, বরং প্রযুক্তিনির্ভর ও উচ্চ মূল্য সংযোজিত পণ্যে বিনিয়োগও বাড়বে। এ অবস্থায়, সরকারের উচিত হবে কর-নীতি সহজীকরণ, বন্ড সুবিধা সংস্কার, রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোর জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং দক্ষ শ্রমিক তৈরি। কারণ রপ্তানির অর্ডার বেড়ে গেলে দক্ষ জনশক্তির চাহিদাও সমানভাবে বাড়বে।
অন্যদিকে, চট্টগ্রামের গার্মেন্টস খাতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে কারণ এখান থেকেই বাংলাদেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় অর্ধেক যুক্তরাষ্ট্রে যায়। এই অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, বন্দর সুবিধা এবং দীর্ঘদিনের রপ্তানিকারক অভিজ্ঞতা একে অন্য যেকোনো অঞ্চল থেকে এগিয়ে রাখে। তাই এই সুযোগকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে যে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে—১০০ বিলিয়ন ডলার—তা বাস্তবায়ন শুধু সম্ভবই নয়, বরং আগেভাগেই অর্জন করা সম্ভব।
এখানে মনে রাখা দরকার, বিশ্ববাজারে ক্রেতারা এখন শুধু দামে নয়, গুণগত মান, সময়নিষ্ঠতা, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার মতো বিষয়েও গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের এই দিকগুলোতেও মনোযোগ দিতে হবে। বিশেষ করে কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষা, জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহার, এবং পরিবেশবান্ধব কারখানা গঠনে বিনিয়োগ দরকার।
অতএব, সরকার যদি সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা যদি সেই নীতির আলোকে প্রযুক্তি, দক্ষতা ও সেবার মান উন্নয়নে কাজ করেন—তাহলে এই মুহূর্তে উদিত রপ্তানির আশার আলো আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তিতে রূপ নিতে পারে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেমন সমৃদ্ধ হবে, তেমনি তৈরি হবে লাখ লাখ নতুন কর্মসংস্থান, যা অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতেও সহায়ক হবে। এই পথচলায় চট্টগ্রাম হবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক অনন্য কেন্দ্রবিন্দু।
আপনার মতামত জানানঃ