বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তন ও বহির্বিশ্বে ক্রমবর্ধমান বিরোধপূর্ণ অবস্থান ভারতের জন্য নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে। শেখ হাসিনার পতনের পর ভারত যে রকম দ্রুততার সাথে ইউনূস-নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তা তাদের কূটনৈতিক দোদুল্যমানতারই প্রতিফলন। দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে ভারত শেখ হাসিনাকে ঘিরেই বাংলাদেশের রাজনীতি পরিচালনায় প্রভাব বিস্তার করছিল, তা যেন হঠাৎ করে একটি বন্ধ দরজার মুখে এসে থেমে গেছে। অথচ ভারত এতদিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগকেই বাংলাদেশে একমাত্র ভরসাযোগ্য ও নিরাপদ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখে এসেছে। এখন, হাসিনার অবর্তমানে ভারত যেন খুঁজে ফিরছে নতুন বাংলাদেশকে—not হাসিনা, বরং পুরো দেশটিকে।
শেখ হাসিনার ভারত-নির্ভর কূটনীতি যে শেষমেষ ব্যুমেরাং হয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে ভারতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের কথাবার্তায়। ঢাকায় তার ফেরা নিয়ে দিল্লি এখন সম্পূর্ণ নীরব। তবে এই নীরবতা নিছক কৌশলগত। কারণ দিল্লি তার সাবেক ‘প্রতিভূ’কে ফেরত পাঠানোর কথা একদিকে উপেক্ষা করছে, অন্যদিকে তাকে সরাসরি মুখ খুলতেও দিচ্ছে না। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎও ভেস্তে যাচ্ছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের তিন সপ্তাহ ধরে দিল্লিতে বসে থেকেও হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না পারাটা কূটনীতিক মহলে প্রবল বার্তা বহন করছে।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের কূটনৈতিক কৌশলে বড় ধরনের পুনর্বিন্যাস চোখে পড়ছে। তারা এখন আওয়ামী লীগের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে এবং বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক মেরুকরণের উপর নজর রাখছে। ভারত প্রথমবারের মতো বুঝতে পারছে, তারা এক ঝুড়িতে সব আম রেখেছিল। ফলাফল স্বরূপ তারা আজ বাংলাদেশে জনসমর্থন হারিয়ে ফেলেছে। হাসিনাকে কেন্দ্র করে তাদের একতরফা নীতি—যা বিগত পনের বছর ধরে চালু ছিল—সেটাই এখন বিপরীত ফল দিয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের ভাবমূর্তি আজ এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত যে, কোনো রাজনৈতিক দলই প্রকাশ্যে ভারতপন্থী কথা বলার সাহস দেখাচ্ছে না।
বাংলাদেশে মোদি সরকারের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি মূলত ইউনূস সরকারের প্রতি সন্দেহভাজন। শেখ হাসিনার পতনের পরে মোদি সরকার যে দ্রুত ইউনূস সরকারকে স্বীকৃতি দিল, তা কৌশলগত হলেও আস্থাহীনতার ছাপ এতে স্পষ্ট। ভারতে বসে এখন অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশ পাকিস্তানের পথেই হাঁটছে। ফলে, মাইলস্টোন স্কুলে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার পর যদিও ভারত মানবিকতা দেখিয়ে চিকিৎসক পাঠিয়েছে, কিন্তু একইসাথে তারা তাদের বাণিজ্য কার্যক্রম গুটিয়ে নিচ্ছে, ভিসা বন্ধ করছে, সীমান্তে হত্যা অব্যাহত রেখেছে এবং পুশ-ইনকে দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত করেছে।
এই হিমশীতল সম্পর্ক পুনরায় উষ্ণ করতে বাংলাদেশ দিল্লিতে এক অভিজ্ঞ কূটনীতিককে হাইকমিশনার হিসেবে পাঠিয়েছে। তিনি দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেও বরফ গলছে না। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া এই সম্পর্ক পুনরায় চাঙ্গা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন এবং তার গতি-প্রকৃতির উপর। ভারত, একসময়ের একতরফা নির্বাচন-পন্থী দেশ, এখন সব দলের অংশগ্রহণ চায়—তবে তাতেও নিঃসন্দেহে একটি নিরাপত্তা খোঁজার প্রচেষ্টা আছে।
ভারত যে নির্বাচন ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে দেনদরবার করেছে, সেটিও আর গোপন নেই। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত ভারত-আমেরিকা বৈঠক ফলপ্রসূ না হলেও এর ইঙ্গিত পরিষ্কার—দিল্লি ওয়াশিংটনের ‘নাক গলানো’ এড়াতে চায়, যদিও আমেরিকা চুপ থাকলেও তা ক্ষোভহীন নয়। এই অবস্থানে ভারতের বিরক্তি যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি ওয়াশিংটনের উদাসীনতাও চিন্তিত করেছে দিল্লিকে।
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয়। ভারতীয় গোয়েন্দারা যাদের উপর শেখ হাসিনা পুরোপুরি নির্ভর করতেন, তারাই আজ ব্যর্থতা নিয়ে বিতর্কে জড়িত। ঢাকা শহরের গোয়েন্দারা প্রকাশ্যে অভিযোগ করছে, হাসিনা স্থানীয়দের কথা বিশ্বাস করতেন না—শুধু ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উপর নির্ভর করতেন। এই তথ্যগুলো এখন ভারতেও আলোচিত হচ্ছে, এবং তাদের পূর্বের একতরফা নীতির ভ্রান্তি উপলব্ধি করতে বাধ্য করছে।
চরম দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ভারতের জন্য নতুন চিন্তার খোরাক। তারা এতদিন ধরে ইসলামপন্থীদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করলেও আজ বুঝতে পারছে, এদের শত্রু বানিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বন্ধু হওয়া অসম্ভব। কারণ, আজকের বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা একটি সামাজিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। জনগণ বিশ্বাস করছে, ভারত শুধুই স্বার্থপর মিত্র ছিল; সত্যিকারের বন্ধু নয়। এমনকি ভারতকে ‘ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের শত্রু’ বলেও একাংশের মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের প্রতি এই ঘৃণা শুধু রাষ্ট্রীয় নয়, বরং তা এখন সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় আবেগের স্তরেও পৌঁছে গেছে।
এই পরিস্থিতিতে ভারত দুই ধরনের কৌশল নিচ্ছে: একদিকে হাসিনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলছে, অন্যদিকে বিকল্প শক্তিকে পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে সম্পর্ক রক্ষার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—এই বিকল্প কারা? বিএনপি, জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট, নাকি কোনো নতুন উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তি? অথবা কি ভারত আবারও “মির্জাফর”-সৃষ্টির পুরনো ফর্মুলায় ফিরে যাচ্ছে? কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, ভারত হয়তো এমন একটি নতুন ‘নিরপেক্ষ’ শক্তিকে খুঁজছে, যাকে ভোট ছাড়াই ক্ষমতায় বসানো সম্ভব হবে, যেন নির্বাচন একটি নাটক হয়, আর আসল সিদ্ধান্ত হয় দিল্লির টেবিলে।
তবে এটা নিশ্চিত, ভারতের কৌশল যতই পাল্টাক না কেন, বাংলাদেশের জনগণের মন জয় করতে হলে তাদের ভাবনার আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। সম্পর্কের ভিত্তি হতে হবে সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্বার্থরক্ষা। শুধু একটি দলকে সমর্থন করে গোটা একটি দেশের জনগণের স্বার্থকে অগ্রাহ্য করলে তা দীর্ঘমেয়াদে কখনোই ফলপ্রসূ হবে না। আজ ভারত এটাই উপলব্ধি করছে।
বাংলাদেশে সামনের মাসগুলো রাজনৈতিক দিক থেকে সংকটময় হতে চলেছে। ভারত যদি সত্যিই বাংলাদেশকে চায়, তাহলে তাদের কৌশলিক অংশীদার নয়—একটি সার্বভৌম ও স্বাধীন দেশের প্রতি বন্ধুসম মনোভাব নিয়ে এগোতে হবে। শেখ হাসিনা এখন ইতিহাস, বাংলাদেশ তার নতুন সত্য। ভারত যদি এই বাস্তবতা বুঝে, তাহলেই কেবল এই অঞ্চলের রাজনৈতিক শান্তি ও কূটনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
আপনার মতামত জানানঃ