বাংলাদেশ ২০২৪ সালের আগস্টে এক বৃহৎ গণআন্দোলনের সাক্ষী হয়, যেখানে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপক প্রতিবাদ ও ঐতিহাসিক গণজাগরণ ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক শক্তি পরিবর্তনের প্রতীক ছিল না, বরং এটি মানুষের মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার আশা নিয়ে নতুন এক যুগের সূচনা হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা হতাশাজনক। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
তারা বলেছে, নির্বিচার গ্রেপ্তার এখনও অব্যাহত রয়েছে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা কমেনি। এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আগের শাসকের দমনমূলক নীতিরই রূপ বলে মনে হচ্ছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে এবং আইনের প্রতি আস্থা কমে গেছে। একই সঙ্গে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় উচ্ছৃঙ্খল ‘মব সন্ত্রাস’ তথা জনতার নিয়ন্ত্রিত সহিংসতার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা রাজনৈতিক বা সামাজিক উত্তেজনার ফলে সংঘটিত হচ্ছে। এসব সহিংসতায় বহু মানুষ আহত ও নিহত হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে, যা মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলেছে।
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নিপীড়ন ও হুমকির ঘটনাও বাড়ছে, যার ফলে তাদের সুরক্ষাহীনতা এবং দুর্বল অবস্থার মাত্রা বেড়েছে। জনগণের প্রত্যাশা ছিল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে, কিন্তু বাস্তবে এটি ব্যর্থতার স্বীকার। নারীদের নিরাপত্তা পরিস্থিতিও ভয়াবহ, যেখানে প্রকাশ্যে নারীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন, অপমান, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘মোরাল পুলিশিং’ নামে তাদের পোশাক, আচরণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা তীব্র হচ্ছে, যা নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ সংকুচিত করছে। এসব সহিংসতা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি কাঠামোগত সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
শিক্ষাঙ্গনের অবস্থা করুণ; শিক্ষার্থীদের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে, অনেকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার ও সনদ বাতিলের শিকার হচ্ছেন। সংবাদমাধ্যমও নানা রকম হয়রানির মুখে পড়ছে, যার ফলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে এবং মতপ্রকাশের অধিকার বিপন্ন হচ্ছে। এর ফলে সমাজে তথ্যের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, যা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু ইতিবাচক উদ্যোগও রয়েছে। বলপূর্বক গুম থেকে রক্ষার আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর এবং গুমের অপরাধ তদন্তের জন্য একটি কমিশন গঠনকে আসক দায়িত্বশীল পদক্ষেপ হিসেবে মূল্যায়ন করেছে। তবুও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পুনর্গঠন না করায় সরকারের মানবাধিকার রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি ঘোষণা করার সিদ্ধান্তকে আসক গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং আশা প্রকাশ করেছে যে, এটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের জন্য পথ সুগম করবে। তারা জোর দিয়ে বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, নির্বিচার গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে, মব সন্ত্রাস ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নারীদের প্রতি সহিংসতায় ‘জিরো টলারেন্স’ কার্যকর করা জরুরি। মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা এবং সভা-সমাবেশ ও সংগঠনের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতেও সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে অর্জিত গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের সার্থকতা ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই রাষ্ট্রকে এখনই মানবাধিকারবান্ধব, দায়িত্বশীল ও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে, যাতে জনগণের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত হয়।
আপনার মতামত জানানঃ