যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রেক্ষিতে ভারতের পোশাক শিল্প এক গভীর সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে মার্কিন বাজারে ভারতের অবস্থান এখন হুমকির মুখে, কারণ ক্রেতারা উচ্চ শুল্কের কারণে ভারত থেকে পোশাক কেনা স্থগিত করছেন কিংবা উৎপাদন অন্য দেশে স্থানান্তরের কথা ভাবছেন।
এই সংকটের সূচনা হয় যখন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়, যার প্রথম দফা ২৫ শতাংশ কার্যকর হয়েছে ৭ আগস্ট থেকে এবং বাকি ২৫ শতাংশ কার্যকর হবে ২৮ আগস্ট। এ অবস্থায় মার্কিন ব্র্যান্ড গ্যাপ, কোল’সসহ অনেক বড় কোম্পানি ভারতের পোশাক রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানাচ্ছেন, তারা বাড়তি খরচ বহন করতে পারবেন না এবং অন্য দেশে উৎপাদন সরানোর বিকল্প খুঁজছেন। এই পরিস্থিতিতে ভারতের অনেক রপ্তানিকারক যেমন পার্ল গ্লোবাল, রিচাকো এক্সপোর্টস, রেমন্ড ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, নেপাল ও ইথিওপিয়া–এ তাদের উৎপাদন কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
ভারতের তামিল নাড়ুর তিরুপপুর, যেটিকে নিটওয়্যার রাজধানী বলা হয়, সেখানকার কারখানাগুলো সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখানকার কিছু পোশাক মাত্র ১ ডলারে বিক্রি হলেও এখন সে পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হতে যাচ্ছে। ফলে এই অতিরিক্ত খরচ মার্কিন আমদানিকারকরা নিতে চান না। অনেক ক্রেতা তাই অর্ডার স্থগিত করছেন, আবার কেউ কেউ চাইছেন শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগেই বেশি করে পণ্য পাঠাতে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। ভারতীয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান পার্ল গ্লোবালের অন্যতম উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে বাংলাদেশে, এবং তারা ইতোমধ্যেই মার্কিন ক্রেতাদের নির্দেশে এখানকার উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের বেশ কিছু কারখানায় নতুন করে অর্ডার আসতে শুরু করেছে, যা বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য একটি বড় সুযোগ হয়ে উঠছে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের তুলনামূলক কম শুল্কহার এবং দক্ষ শ্রমশক্তির কারণে অনেক ব্র্যান্ড এখন ভারতের পরিবর্তে বাংলাদেশকে বেছে নিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের তৈরি পোশাক খাতের জন্য এটি একটি “পয়েন্ট অব রিস্ট্রাকচারিং”। কারণ রপ্তানিকারকরা বাধ্য হচ্ছেন বিকল্প দেশ বেছে নিতে। অন্যদিকে, প্রতিযোগী দেশগুলো—বিশেষত বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম এবং ইথিওপিয়া—এই শুল্ক পরিস্থিতিকে নিজেদের জন্য বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশের ওপর শুল্কহার ২০ শতাংশ হলেও এটি ভারতের ৫০ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। ফলে, মার্কিন ব্র্যান্ডগুলো আরও স্থায়ীভাবে বাংলাদেশের দিকেই ঝুঁকছে।
ভারতের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি শুধু ভারতের রপ্তানি খাতের জন্য নয়, বরং সমগ্র দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘চীন প্রতিস্থাপন কৌশল’-এর কারণে যে দেশগুলো বিকল্প উৎস হিসেবে উঠে এসেছিল—তার মধ্যে ভারত অন্যতম ছিল। কিন্তু নতুন এই শুল্ক নীতির ফলে ভারতের সেই সম্ভাবনাও এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নতুন করে মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার চেষ্টা করছে। তবে, এই শুল্ক আরোপ অনেকটাই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ফল, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের বছর এবং অভ্যন্তরীণ চীনা বাজার নিয়ে উত্তেজনার প্রভাব রয়েছে।
সবমিলিয়ে, ভারতের তৈরি পোশাক খাত এখন এক দিকচিহ্নহীন সঙ্কটে পড়েছে—যেখানে আন্তর্জাতিক কূটনীতি, মার্কিন অর্থনৈতিক কৌশল, এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সব মিলিয়ে একটা বিশাল ধাক্কা দিয়েছে। এই ধাক্কা সামাল দিতে ভারতের রপ্তানিকারকরা এখন বাংলাদেশ, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া ও ইথিওপিয়ার মতো বাজারে দ্রুত নিজেদের নতুন করে সংগঠিত করার চেষ্টায় ব্যস্ত। আর এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় লাভবান হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, যদি সময়মতো উৎপাদন সক্ষমতা ও অবকাঠামো ব্যবস্থাপনায় দেশটি আরও মনোযোগ দিতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ