ওয়াশিংটন যখন ভারতের প্রতি তার নীতিতে শাস্তিমূলক সুর ক্রমেই স্পষ্ট করে তুলছে, ঠিক সেই সময় দিল্লিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কূটনীতিতে এমন মুহূর্তগুলো কখনোই কাকতালীয় নয়। এটি ছিল খুব হিসাব করে দেওয়া এক রাজনৈতিক বার্তা—ভারত কারও চাপিয়ে দেওয়া শিবির রাজনীতির অংশ নয়, এবং ‘পশ্চিম বনাম বাকি বিশ্ব’ এই সরলীকৃত দ্বন্দ্বে নিজেকে বাধ্যতামূলকভাবে আটকে রাখতে রাজি নয়।
মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত বারবারই বলে এসেছে যে তারা একটি সার্বভৌম শক্তি, যাদের বৈদেশিক নীতি আদর্শের চেয়ে স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। পুতিনকে দিল্লিতে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করা সেই নীতিরই সাম্প্রতিক ও সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রকাশ। যুক্তরাষ্ট্রের চোখে এটি হয়তো এক ধরনের চ্যালেঞ্জ, কিন্তু ভারতের কাছে এটি তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন রক্ষার প্রয়াস।
যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি ভূরাজনৈতিক কৌশলে ভারতের গুরুত্ব নিয়ে কোনো সংশয় নেই। বিশাল জনসংখ্যা, গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান এবং পারমাণবিক ক্ষমতাসহ শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতার কারণে ভারতই একমাত্র আঞ্চলিক শক্তি, যা এশিয়ায় চীনের আধিপত্য বিস্তারের উচ্চাভিলাষকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারে। এই উপলব্ধি থেকেই জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় থেকে ওয়াশিংটনে ‘ভারত অপরিহার্য’—এই ধারণা গেঁথে যায়।
গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের নিরাপত্তা সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে গভীর হয়েছে। যৌথ সামরিক মহড়া, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি সহযোগিতা—সব ক্ষেত্রেই দুই দেশের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে এই সম্পর্ক আরও গতি পায়। সে সময় চীনের ওপর চাপ বাড়ানো এবং পাকিস্তানের নিরাপত্তা সহায়তা কমানোর মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন কার্যত ভারতের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে। ফল হিসেবে আজ ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি যৌথ সামরিক মহড়া করে এবং যুক্তরাষ্ট্রই ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছে।
তবু এই সহযোগিতার ভেতরেই রয়ে গেছে গভীর এক অবিশ্বাস। যুক্তরাষ্ট্র অতীতে বহুবার ভারতের স্বার্থ উপেক্ষা করেছে—এই স্মৃতি দিল্লির নীতিনির্ধারকদের এখনো তাড়া করে ফেরে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশৃঙ্খল প্রত্যাহার তার অন্যতম উদাহরণ। যদিও সেই চুক্তির ভিত্তি তৈরি করেছিলেন ট্রাম্প, বাস্তবায়ন ঘটে বাইডেনের সময়ে। এর ফল ছিল ভয়াবহ—আফগানিস্তান আবার তালেবানের হাতে চলে যায়, আর অঞ্চলজুড়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়ে যায়। ভারতের কাছে এটি ছিল মার্কিন নেতৃত্বের বিচক্ষণতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন।
এই অবিশ্বাস আরও ঘনীভূত হয় ২০২২ সালে। বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানকে আইএমএফ ঋণ পেতে সহায়তা করে এবং পরে পাকিস্তানের মার্কিন তৈরি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান আধুনিকায়নের জন্য ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি অনুমোদন দেয়। ভারতের কাছে এটি শীতল যুদ্ধের পুরোনো ক্ষতকে আবার উসকে দেয়—যখন পাকিস্তানকে আমেরিকার অস্ত্রে সজ্জিত করে ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগকে উপেক্ষা করা হতো।
ট্রাম্পের বর্তমান ভূমিকায় সেই হতাশা আরও গভীর হয়েছে। ব্যক্তিগত লাভ ও লেনদেনমুখী রাজনীতির ছাপ পড়ে তার পররাষ্ট্রনীতিতে। পাকিস্তানের প্রতি সমর্থনের পেছনে ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক স্বার্থ কাজ করছে—এমন ধারণা দিল্লিতে সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ভারতের জন্য এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি করে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা আশা করেছিল, ভারত তাদের নিষেধাজ্ঞা নীতিতে পূর্ণ সমর্থন দেবে। কিন্তু ভারত সেই পথে হাঁটেনি। দিল্লির কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল ভৌগোলিকভাবে দূরের এক সংঘাত, যার দায় নিজের অর্থনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তার ওপর চাপিয়ে নেওয়ার মতো বিলাসিতা ভারতের নেই। বরং ভারত রাশিয়ার সস্তা তেল আমদানি বাড়ায়।
এ ক্ষেত্রে ভারতের সামনে একটি স্পষ্ট নজির ছিল। ২০১৯ সালে ট্রাম্প যখন ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা ফের আরোপ করেন, তখন ভারত তার অন্যতম সস্তা ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানি উৎস হারায়। সেই সুযোগে চীন ইরানের তেল কম দামে কিনতে শুরু করে এবং সেখানে নিজের নিরাপত্তা ও কৌশলগত উপস্থিতি জোরদার করে। দিল্লি বুঝেছিল, নিষেধাজ্ঞার রাজনীতি শেষ পর্যন্ত চীনের লাভই বাড়ায়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও একই চিত্র ফুটে ওঠে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে চীনের ওপর। চীন স্থলপথে জ্বালানি আমদানির পথ মজবুত করে এবং জানে যে, তাইওয়ান নিয়ে তারা যা-ই করুক, রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহে বড় বাধা আসবে না। এই বাস্তবতা সরাসরি ভারতের কৌশলগত স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। তাই ভারতও সুযোগ নেয়—রাশিয়ার সস্তা তেল কিনে নিজের অর্থনীতিকে চাঙা রাখে।
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এই সিদ্ধান্তকে সহজভাবে মেনে নেয়নি। বরং ভারতের রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে মোট শুল্কহার ৫০ শতাংশে নিয়ে যায়। সঙ্গে ছিল গৌণ নিষেধাজ্ঞার হুমকি। যুক্তি দেওয়া হয়—ভারত নাকি রাশিয়ার ‘ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড’ ঠেকাতে আমেরিকার প্রচেষ্টাকে দুর্বল করছে। আরও বিস্ময়কর হলো, একই সময়ে রাশিয়ার তেল কেনা অন্যান্য দেশকে ট্রাম্প ছাড় দিয়েছেন। হাঙ্গেরির স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর অরবানের ক্ষেত্রে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছে, কারণ তিনি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
এর ফলে এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা তৈরি হয়। ভারতের ওপর আরোপিত শুল্ক এখন চীনের রপ্তানির ওপর আরোপিত শুল্ককেও ছাড়িয়ে গেছে। এটি কার্যত ভারতের বিরুদ্ধে এক ধরনের অর্থনৈতিক যুদ্ধ। মুখে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অপরিহার্য বলে দাবি করলেও, বাস্তবে তাদের নীতি ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং কৌশলগত স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এই দ্বৈত আচরণ ভারতের মনোভাবকে বদলে দিচ্ছে। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা এখন ক্রমে বেশি জোর দিচ্ছেন আত্মনির্ভরতা, সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিকল্প অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার ওপর। রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সেই কৌশলেরই অংশ। পুতিনের দিল্লি সফর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা—অতিরিক্ত চাপ আর নীতির হঠাৎ মোড় ঘোরানো শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক দুর্বলই করবে।
বাস্তবতা হলো, চীনের আগ্রাসী উত্থান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে খুব বেশি কার্যকর পথ নেই। ভারতের সঙ্গে এক ধরনের স্বার্থভিত্তিক, নমনীয় ‘নরম জোট’ গড়ে তোলাই তাদের সবচেয়ে বাস্তবসম্মত বিকল্প। সেই সমীকরণে যুক্তরাষ্ট্রের ভারতকে যতটা দরকার, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রকে তার চেয়ে কম দরকার—এই উপলব্ধি দিল্লিতে ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে।
এই কারণেই ভারতকে ‘লাইন মেনে চলতে’ বাধ্য করার কৌশল উল্টো ফল দিতে পারে। ভারত নিজেকে আর কোনো শিবিরের জুনিয়র অংশীদার হিসেবে দেখতে চায় না। দিল্লির প্রত্যাশা, তাকে সমমর্যাদার শক্তি হিসেবে দেখা হোক, নিজের স্বার্থ ও বাস্তবতা মেনে চলার অধিকার স্বীকার করা হোক।
মোদির সঙ্গে পুতিনের উষ্ণ করমর্দন তাই কেবল দুই নেতার ব্যক্তিগত সৌহার্দ্যের ছবি নয়। এটি একটি বার্তা—ভারত তার নিজের পথে হাঁটবে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রশ্নটা এখন একটাই: তারা কি এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ভারতের সঙ্গে পরিণত, বাস্তবভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে, নাকি চাপ আর শাস্তির নীতিতে গিয়ে এমন এক অংশীদারকেই দূরে ঠেলে দেবে, যাকে তারা চীনের বিরুদ্ধে নিজেদের সবচেয়ে বড় সম্পদ বলে মনে করে?
আপনার মতামত জানানঃ