শ্রীলংকা স্বল্পমেয়াদি ঋণের ফাঁদে পড়েছিল, বাংলাদেশেও এমন ঋণ বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সেমিনারে আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘দেশের মেগা অবকাঠামো প্রকল্পগুলো বিদেশী ঋণে করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে ২০-৫০ শতাংশ বেশি ব্যয় হচ্ছে।’
দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সিপিডির প্রতিষ্ঠাতা রেহমান সোবহান বলেন, ‘শ্রীলংকা স্বল্পকালীন ঋণের ফাঁদে পড়েছিল। স্বল্পমেয়াদি অনেক ঋণ নিয়েছিল দেশটি। কিন্তু হঠাৎ রফতানি কমে আসায় এসব ঋণ যথাযথভাবে পরিশোধ করতে পারেনি। আফ্রিকার কিছু দেশেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ তেমন অবস্থানে নেই। কিন্তু দেশে স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তাই রফতানি ৪৫ থেকে ১০০ বিলিয়নে নেয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আলোচনায় দক্ষতা বাড়াতে হবে।’
প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এখানে দুর্নীতির সমস্যা আছে। ক্রনিক ক্যাপিটালিজম আছে। মেগা প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হচ্ছে। তবু ঋণ ব্যবস্থাপনা ও সঠিক ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পিপিপি প্রকল্পে সব লাভ নিয়ে নিচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। আর সব ঝুঁকি যাচ্ছে সরকারের ঘাড়ে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘তিন বছর আগে মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ টাকা। এখন তা দেড় লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিদেশী ঋণের চেয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণ দ্বিগুণ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণের দায় শোধ করার জন্যই রাজস্ব বাজেটের ৩৪ শতাংশ ব্যয় করতে হয়েছে। ফলে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো যাচ্ছে না। ২০১৮-১৯ সালের পর থেকেই ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। ঋণ গ্রহণের সক্ষমতা এখন সবুজ, হলুদ পেরিয়ে খয়েরি পর্যায়ে রয়েছে। ২০-২৫ বছর বয়সী তরুণরা এসব ঋণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
এ অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘মানবকল্যাণের জন্যই ঋণ নেয়া হয়। কিন্তু গত দেড় দশকে ঋণ করে অনেক মেগা প্রকল্প করা হলেও তা মানুষের উন্নতিতে কাজে আসেনি। বরং দেশে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার বেড়েছে। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। বেকার বেড়েছে। বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি হয়নি। উন্নয়ন প্রকল্পের ৭০ শতাংশ নেয়া হয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে। ফলে খাতভিত্তিক উন্নয়ন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। প্রকল্প থেকে একটি গোষ্ঠী লাভবান হয়েছে।’
মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্ষমতা ছাড়ার পরই মেগা প্রকল্প প্রয়োজন নেই বলছেন। আর একটি শ্রেণী ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত না দিয়ে এবং শেয়ারবাজারের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে প্রাথমিক সঞ্চয় গড়ে তুলছে। যেকোনো রাজনৈতিক সরকারেরই এমন পরিস্থিতিতে চিন্তিত হওয়া উচিত।’ মেগা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিরা বিদেশে টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন এ অর্থনীতিবিদ।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘গত এক যুগে দেশের বৈদেশিক ঋণ ও রাষ্ট্রায়ত্ত ঋণ গ্যারান্টির পরিমাণ তিন গুণ বেড়েছে। আর এসব গ্যারান্টি সামনের দিনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে।’ একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের সক্ষমতার দিক দিয়ে দেশ এখন মধ্যম থেকে ‘দুর্বল’ শ্রেণীর কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে বলেও জানান তিনি। ঋণের পরিমাণকে জিডিপির হিসাবে না দেখে বরং রাজস্বের সঙ্গে তুলনার কথা বলেন এ অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, ‘রাজস্বের বিপরীতে দেশের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ২০০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। গত বছর দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ ৩৭ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ঋণের সুদহার বাড়ায় এসব ঋণ এখন ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে। দেড় শতাংশ সুদ হিসেবে ঋণ নেয়া হলেও তা সাড়ে ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমনকি জ্বালানি তেলের জন্য ৭ শতাংশ সুদে ছয় মাসের ঋণ নেয়া হচ্ছে।’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বৈদেশিক ঋণের বড় অংশ শোধ করা হচ্ছে নতুন ঋণ নিয়ে। কিন্তু বাজেটে সুদ পরিশোদের হিসাব দেখানো হলেও ঋণের আসল পরিশোধের হিসাব দেখানো হচ্ছে না। এখন ঋণ পরিশোধে রাজস্ব বাড়ানো ছাড়া ভিন্ন কোনো বিকল্প নেই। নতুন ঋণের ক্ষেত্রে টাকায় ঋণ পরিশোধের শর্তের বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।’
সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিভিন্ন দেশের ঋণের ফাঁদ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তাই ঋণের সঠিক ব্যবহার করাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার মতে, প্রকল্প ঋণের চেয়ে বাজেট সাপোর্ট ভালো। এখন দ্বিপক্ষীয় ও বাজারভিত্তিক ঋণ এড়িয়ে চলা উচিত।’
মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি বলেন, ‘বিদেশী ঋণ জাতীয় স্বার্থে নেয়া হচ্ছে কিনা তা নিয়ে দীর্ঘদিনের প্রশ্ন রয়েছে। জবাবদিহি না থাকায় বড় প্রকল্পে বড় দুর্নীতি হচ্ছে। জিডিপি বাড়লেও রাজস্ব বাড়ছে না। তাই জিডিপি নিয়ে প্রশ্ন আছে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. মসিউর রহমান যুক্তি খণ্ডন করে বলেন, ‘উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলে বিনিয়োগ দরকার। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশী সহায়তার প্রয়োজন পড়বে। তবে প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা ও মানের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দরের সঙ্গে আমাদের মেগা প্রকল্পের পার্থক্য রয়েছে। রূপপুরের দীর্ঘমেয়াদ বিবেচনা করলে এটা ব্যয়বহুল মনে হবে না। আর পদ্মা সেতু উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ