
‘আমি কী অপরাধ করেছি’—এই প্রশ্নটি আজ আর কেবল একটি বাক্য নয়, বরং হয়ে উঠেছে এক গভীর রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক ট্র্যাজেডির প্রতীক। শেখ হাসিনার এই উক্তি, যার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে সহস্র প্রাণের আর্তনাদ, যেন প্রমাণ করে দেয়—ক্ষমতা যখন ফ্যাসিবাদে রূপ নেয়, তখন অনুতাপ নয়, আত্মপক্ষ সমর্থনই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় কৌশল।
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা ছিল না, এটি ছিল মানুষের সম্মিলিত চিৎকার—অবিচারের বিরুদ্ধে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে, ভোটবঞ্চিত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘের নিরপেক্ষ তদন্ত বলছে, সেই অভ্যুত্থানে কমপক্ষে ১,৪০০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি। এই পরিসংখ্যান এক দেশীয় বিরোধী দলের দাবি নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের গবেষণালব্ধ ফলাফল। তারপরও, শেখ হাসিনা ও তাঁর দল সেই হত্যার দায় অস্বীকার করে চলেছেন অনড়ভাবে।
তাঁদের এই অস্বীকারের পথ আজও থামেনি। বরং বিবিসি ও আল–জাজিরার মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম যখন একইসঙ্গে ভিডিওচিত্র, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য ও স্যাটেলাইট চিত্র দিয়ে হাসিনার সরাসরি দায়প্রমাণ করেছে, তখনো তিনি ও তাঁর সহযোগীরা অস্বীকারকেই বেছে নিয়েছেন। যেভাবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের অনুসন্ধান প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে, সেভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে জনগণের চেতনা, বিবেক ও বেদনার সমূহ সঞ্চার।
এই পর্যায়ে এসে প্রশ্ন উঠতেই পারে—এই অস্বীকার কেন? এই অনুতাপহীনতা কীভাবে সম্ভব? উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হয় ইতিহাস আর মনস্তত্ত্বের গভীরে।
বিশ্ব ইতিহাসে দক্ষিণ আফ্রিকা, রুয়ান্ডা, কানাডা, চিলি, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া প্রমাণ করে দিয়েছে—ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন (টিআরসি) কেবল শান্তি ফেরায় না, ফেরায় একটি জাতির আত্মমর্যাদাও। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা শ্বেতাঙ্গ নিপীড়কদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমার নীতি গ্রহণ করেন। রুয়ান্ডায় আরপিএফ নেতৃত্ব পল কাগামে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নিয়ে মাফ ও পুনর্মিলনের পথ দেখান। এমনকি কানাডা পর্যন্ত তাদের শতবর্ষ আগের আদিবাসী নিপীড়নের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চেয়েছে।
বাংলাদেশেও কি সে পথ সম্ভব ছিল না?
প্রশ্নটা এখানেই নয়—সম্ভব ছিল, কিন্তু ইচ্ছা ছিল না। বরং শেখ হাসিনা বেছে নিয়েছেন ইতিহাসের ভিন্ন এক ছায়াপথ—যেখানে অনুতাপ নয়, বরং ক্ষমতা আঁকড়ে ধরা, ফ্যাসিস্ট বয়ান তৈরি করা এবং সত্যকে অস্বীকার করাই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রচালনার মূলমন্ত্র। এই পথ পলপটের, মুসোলিনির, এবং আধুনিক পৃথিবীতে যেকোনো অনুতাপহীন স্বৈরশাসকের।
বিভাজনের রাজনীতি শেখ হাসিনার সবচেয়ে সফল রাজনৈতিক কৌশল। তিনি ‘মুক্তিযোদ্ধা বনাম রাজাকার’, ‘দেশদ্রোহী বনাম দেশপ্রেমিক’, ‘জঙ্গিবাদ বনাম উন্নয়ন’—এই সব কল্পিত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, জাতিকে দুই ভাগে বিভক্ত রেখে নিজের রাজনীতিকে স্থায়ী করতে চেয়েছেন। কিন্তু এই বিভাজন প্রতিদিন বাংলাদেশকে দুর্বল করছে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল, বিচারব্যবস্থা পক্ষপাতদুষ্ট, মানবাধিকার লঙ্ঘিত—আর এই ফাটল জোড়া দিতে পারত একটি ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন, যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মানসিকতায় একেবারেই অনুপস্থিত।
এখন প্রশ্ন উঠছে—আওয়ামী লীগ কেন অনুতপ্ত নয়? কেন তারা স্বীকার করে না ২০২৪ সালের দমন-পীড়নের দায়? উত্তর পাওয়া যায় মনোবিদ লিওন ফেস্টিঞ্জারের ‘কগনিটিভ ডিসোনেন্স’ তত্ত্বে। তাঁর মতে, মানুষ যখন নিজের আচরণকে যৌক্তিক করতে পারে না, তখন সে নিজেই নতুন যুক্তি তৈরি করে, যাতে তার অযৌক্তিক আচরণকে যৌক্তিক প্রমাণ করা যায়। ক্ষমতা, লোভ, দুর্নীতি, হিংস্রতা—সবকিছুই তখন ‘দায়িত্ব’, ‘রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে’ কিংবা ‘অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র প্রতিরোধের নাম’ পায়।
এই মনস্তত্ত্বের ভিত্তিতে আজ আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা হুবহু সেই আচরণ দেখাচ্ছে—যতই তথ্য আসুক, যতই প্রমাণ আসুক, তারা বিশ্বাস করছে না; বরং উল্টো গুজব ও প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে, এবং হাসিনার নেতৃত্বকে ভগবানের মতো অন্ধভাবে অনুসরণ করছে। এটাই ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির মৌল বৈশিষ্ট্য। জার্মান মনোবিশ্লেষক উইলহেম রাইখের ভাষায়, এ হলো ‘ম্যাস সাইকোলজি অব ফ্যাসিজম’—যেখানে জনগণ নিজের দুঃখ-বেদনা ভুলে স্বৈরশাসকের প্রতি একধরনের মোহে বাঁধা পড়ে যায়।
আরেক মনোবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট বান্দুরা এর নাম দিয়েছেন ‘মরাল ডিসএনগেজমেন্ট’—যেখানে হিংস্রতাই হয়ে ওঠে দায়িত্ব, এবং বিচারহীনতাই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রনীতি।
ফলাফল কী? ফলাফল হলো, এক বছরের মাথায় আমরা দেখি না কোনো অনুশোচনা, দেখি না কোনো স্বীকারোক্তি, দেখি না কোনো শুদ্ধি অভিযানের নামগন্ধ। বরং, দেখি নতুনভাবে ক্ষমতায় ফেরার জন্য দলটির সর্বশক্তি প্রয়োগ, দেখি ইতিহাস বিকৃতি, দেখি নিজেরা নির্যাতিত বলে জাহির করা। দেখা যায় না কেবল একটি জিনিস—সত্যকে মেনে নেওয়ার সাহস।
এমন নয় যে আওয়ামী লীগ সবসময় হিংস্র দল ছিল। এটি এক সময়ের মহান সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল, দেশের বড় ও পুরনো দল। তাই এই দলের ইতিহাস বিকৃত হওয়া মানে বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃত হওয়া। কিন্তু যখন একটি দল অনুতাপ নয়, বরং অহঙ্কারকে বেছে নেয়, তখন সেই দল নিজের অস্তিত্বই বিলীন করে ফেলে—যেমনটি করেছিল মুসলিম লীগ।
শেষ কথা হলো, সত্যকে অস্বীকার করে, অনুতাপ না করে, ইতিহাসের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার শেষরক্ষা হয়নি। শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের সামনে এখনো সময় আছে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়নের পথ ধরার। না হলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। মানুষ ভুলে যেতে চায়, মাফ করে দিতে চায়, কিন্তু তার আগে জানতে চায়—প্রতিশ্রুতি কী, অনুশোচনা কতটা গভীর।
‘আমি কী অপরাধ করেছি?’—এই প্রশ্নটা যদি সত্যিই হাসিনার হয়, তবে তাঁর উচিত প্রশ্নের উত্তর খোঁজা নয়, বরং তার দায় স্বীকার করে উত্তর হওয়া।
আপনার মতামত জানানঃ