ফেনীর পরশুরামে বিএসএফের গুলিতে দুই বাংলাদেশির মৃত্যু শুধু একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি দীর্ঘদিনের একটি রক্তাক্ত বাস্তবতার ধারাবাহিকতা। প্রতি বছর এই সীমান্তে বারবার রক্ত ঝরে, বারবার দেশের ভেতরে প্রতিবাদ হয়, সংবাদপত্রে শোকবার্তা ছাপে, আর রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি বিবৃতি জারি হয়—এই নিঃসঙ্গ চক্রেই বন্দি হয়ে আছে বাংলাদেশের সীমান্তবাসীদের জীবন। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেসামরিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে যে সীমান্তে, সেই ভয়াবহ সীমানার নাম বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। এই বর্ডার আজ পর্যন্ত যত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, তা যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়েও ভয়ানক। সীমান্তের প্রতিটি কাঁটাতারে লেগে আছে রক্ত, কান্না আর ক্ষোভ।
গত ২৫ জুলাই দিবাগত রাত ১২টার দিকে বাসপদুয়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে প্রাণ হারান দুই যুবক—লিটন ও মিল্লাত হোসেন। তাদের সাথে থাকা আফছার নামের এক যুবকও গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন। গুলির পর নিহত লিটনের মরদেহ বিএসএফ ভারতে নিয়ে যায় এবং এখনও তা বাংলাদেশের নাগাল পায়নি। অপরদিকে মিল্লাতের মৃত্যু হয় বাংলাদেশের হাসপাতালে। প্রতিবেশীদের মতে, তারা তারকাঁটা বাউন্ডারির কাছাকাছি ছিলেন, হয়তো সীমান্ত পার হওয়ার উদ্দেশ্যে বা কারও খোঁজে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিএসএফ কোনো সতর্কতা বা বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই গুলি ছোড়ে। একজনকে তারা নিয়ে যায়, অপরজন মারা যায় দেশের মাটিতে, আর একজন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে হাসপাতালে।
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত দুই দশক ধরে এই রকম হাজারো ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১০ সালে বলেছিল, বছরে গড়ে ১০০ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে নিহত হচ্ছেন। এরপর আন্তর্জাতিক চাপ ও মিডিয়া কাভারেজের কারণে সাময়িক বিরতি এলেও পরে তা আবার বাড়তে থাকে। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যেও প্রতিবছর গড়ে ৪০-৬০ জন বাংলাদেশির প্রাণ গেছে সীমান্তে গুলির কারণে। এসব মানুষ অধিকাংশ সময়ই সাধারণ কৃষক, দিনমজুর, কিংবা ছোট ব্যবসায়ী, যাদের অপরাধ অনেক সময়ই ছিল সীমান্তের দুই পাশে আত্মীয়স্বজন বা জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে যাতায়াত।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পৃথিবীর দীর্ঘতম স্থলসীমান্তগুলোর একটি। প্রায় ৪,০৯৬ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত এই সীমান্তের অধিকাংশ অংশে কাঁটাতার বসানো আছে, আর সেখানে মোতায়েন রয়েছে বিএসএফের প্রচুর সদস্য। কিন্তু সীমান্তে গুলি চালানো বা হত্যা কোনো আন্তর্জাতিক আইনসম্মত ব্যবস্থা নয়, বিশেষ করে যখন অপরপক্ষ অস্ত্রহীন ও বেসামরিক হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, সীমান্তে এমন প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তবুও বিএসএফ প্রায়ই নির্বিচারে গুলি চালায়, অনেক সময় সরাসরি সন্দেহের ভিত্তিতে হত্যা করে, যা কার্যত ‘ক্রস বর্ডার এক্সিকিউশন’-এর মতো।
ভারত একসময় বলেছিল সীমান্তে ‘নো কিলিং জোন’ বাস্তবায়ন করবে। ২০১১ সালের সেই ঘোষণার পর কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও বাস্তবে তা কখনোই কার্যকর হয়নি। বরং দেখা গেছে, প্রতি বছর যখনই ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হয়, তখনই সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়, যা অনেক সময় স্থানীয় রাজনৈতিক বা নিরাপত্তা বাহিনীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়েও জড়িত থাকে। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী প্রায়ই চোরাচালান ও অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানোর যুক্তি দেখিয়ে প্রাণঘাতী পদক্ষেপ নেয়। অথচ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন।
প্রতিবার এসব ঘটনার পর বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান থাকে অনেকটা প্রতিক্রিয়ার মতো—‘উদ্বেগ প্রকাশ’, ‘লিখিত প্রতিবাদ’, কিংবা ‘ফ্ল্যাগ মিটিং’-এর আশ্বাস। কিন্তু এসব কার্যত কোনো পরিবর্তন আনে না। সরকার চুপ থাকে, প্রশাসন ব্যস্ত হয়ে পড়ে কাগজপত্রে। নিহতের পরিবার পায় না বিচার, এমনকি অনেক সময় মৃতদেহ ফেরত পাওয়াটাও হয়ে ওঠে কঠিন। ফলে সীমান্তের মানুষদের কাছে রাষ্ট্র হয়ে ওঠে একটি অনুপস্থিত অস্তিত্ব—যা বেঁচে থাকার দায় নেয় না, মরার পরও সম্মান দেয় না।
এই সীমান্তের যে ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, তা বহু চোরাকারবারির জন্য সুবিধাজনক। গরু, ফেনসিডিল, স্বর্ণ, এমনকি নারী ও শিশু পাচার হয় এই বর্ডার দিয়ে। কিন্তু যারা গরীব ও দুর্বল, তারা সহজ টার্গেট হয়ে পড়ে। বাস্তবে দেখা গেছে, অনেক সময় বিএসএফ গুলি চালায় এমন মানুষদের উপর, যারা নিজ দেশে কৃষিকাজ করতে গিয়ে একটু ভুল করে কাঁটাতার অতিক্রম করেছে। একেকটা জীবন এভাবে শেষ হয়ে যায় একটি ভুল ধাপের জন্য। আর সেই মৃত্যুকে ‘অপরাধের বিচার’ বলে বৈধতা দেওয়া হয়।
মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে এই ধরনের সীমান্ত হত্যা এক ধরনের রাষ্ট্রীয় সহিংসতা। বিশ্বের অন্যান্য সীমান্তে যেখানে গুলি চালানোর আগে শব্দচিহ্ন, হর্ন বা নন-লেথাল অস্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেখানে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গুলি চালানোই যেন প্রথম এবং একমাত্র প্রতিক্রিয়া হয়ে উঠেছে। এটি শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং একটি জাতির বিরুদ্ধে পরিচালিত মৌন নিষ্ঠুরতাও।
এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। রাষ্ট্রকে কেবল প্রতিবাদ নয়, প্রতিক্রিয়াশীল এবং কার্যকর কূটনীতি অনুসরণ করতে হবে। সীমান্তে যারা মারা যাচ্ছেন তারা অপরাধী নন—তারা এই রাষ্ট্রেরই নাগরিক, যারা সুরক্ষার অধিকার রাখে। মৃত্যু কখনো বৈধ হতে পারে না, আর সীমান্ত কখনো কবরস্থানে পরিণত হতে পারে না। সীমান্ত কাঁটাতারের সীমানা নয়, এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধের শেষ প্রান্ত। সেই দায়িত্ব উপেক্ষা করে যতবারই কেউ মরবে, ততবারই এই বর্ডার হয়ে থাকবে পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তাক্ত সীমান্ত।
আপনার মতামত জানানঃ