ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা সামনে এসেছে—সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার যুবক জাকারিয়া আহমেদের ঝুলন্ত মরদেহ ২৬ ঘণ্টা পরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে। সীমান্ত হত্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অভিযোগ ও দুঃখজনক ইতিহাসে এটি আরেকটি নতুন সংযোজন। যদিও এই মৃত্যুকে প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যা বলা হচ্ছে, তবু ঘটনাপ্রবাহ, স্থান ও প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রশ্ন তুলছে জাকারিয়ার পরিবার, স্থানীয় মানুষ, এমনকি সীমান্ত বিশ্লেষকরাও।
গত সোমবার বিয়ে করেন জাকারিয়া। এর ঠিক দুই দিন পর বৃহস্পতিবার ভোরে তিনি প্রস্রাব করার কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যান এবং আর ফিরে আসেননি। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে সীমান্ত পিলার ১২৫৮/২০-এস থেকে মাত্র ৫০ গজ ভারতের অভ্যন্তরে একটি গাছে তাঁর মরদেহ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা যায়। এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় বিএসএফ মরদেহ নামাতে দীর্ঘ সময় নেয় বলে দাবি করা হয়। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে সীমান্ত পিলার ১২৫৭/১-এসের কাছে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
জাকারিয়ার পরিবারের দাবি, তাঁর আত্মহত্যার কোনো পূর্ব লক্ষণ ছিল না। তারা সন্দেহ করছে, এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। বিয়ের মাত্র দুই দিন পর কেন এক যুবক আত্মহত্যা করবেন, তা নিয়েই উঠেছে অসংখ্য প্রশ্ন। বিষয়টি নিয়ে ময়নাতদন্ত ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলেছেন তারা।
সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যার ঘটনা নতুন কিছু নয়। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের বিরুদ্ধে একাধিকবার বিনা উস্কানিতে গুলি চালানো, নির্যাতন, এমনকি পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। বহুবার এই ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবাদ জানালেও এর ফলাফল দীর্ঘমেয়াদে খুব একটা কার্যকর হয়নি।
২০১০ সালে সীমান্তে বাংলাদেশিদের ওপর বিএসএফের নির্যাতনের মাত্রা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ওই বছর আনুমানিক ৭৪ জন বাংলাদেশি নাগরিক বিএসএফের গুলিতে কিংবা শারীরিক নির্যাতনে প্রাণ হারান। পরবর্তী বছর ২০১১ সালে নিহতের সংখ্যা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩১ জনে। ২০১২ সালে এই সংখ্যা আরও কমে ১৭ জনে নামলেও পরের বছর ২০১৩-তে তা আবার বেড়ে ২৬ জনে পৌঁছায়।
২০১৪ সালে সীমান্ত হত্যার হার ছিল তুলনামূলকভাবে কম—সেবছর ৬ জন বাংলাদেশি বিএসএফের হাতে নিহত হন। ২০১৫ সালে ৭ জন এবং ২০১৬ সালে ৯ জন নিহত হন। ২০১৭ সালে আবার হত্যার সংখ্যা কিছুটা বাড়ে এবং ওই বছর ১৪ জনের মৃত্যু ঘটে। ২০১৮ সালে ১৫ জন বাংলাদেশি সীমান্তে নিহত হন।
২০১৯ সাল থেকে আবারো সীমান্তে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়। ওই বছর ৪৩ জন বাংলাদেশি সীমান্তে নিহত হন, যা গত দশকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০২০ সালেও এই প্রবণতা বজায় থাকে এবং মোট ৪৫ জন বাংলাদেশি বিএসএফের হাতে প্রাণ হারান। ২০২১ সালে কিছুটা কমে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮ জনে। ২০২২ সালে আবার তা বাড়ে এবং ২৪ জন নিহত হন। ২০২৩ সালে সীমান্ত হত্যার সংখ্যা ২২ জনে পৌঁছায়।
২০২৪ সালেও ১৯ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই আনুষ্ঠানিকভাবে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয় না বলে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। ২০২৫ সালে এখনো বছর শেষ হয়নি, তবে জুন মাস পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে ইতোমধ্যে ১০ জনের বেশি বাংলাদেশি সীমান্তে বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন।
এই ধারাবাহিক মৃত্যু কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে রয়েছে এক একটি পরিবারের বেদনা, এক একটি জীবনের করুণ পরিণতি। ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক যতই দৃঢ় হোক না কেন, সীমান্তে যদি নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা না থাকে, তবে এই সম্পর্কের স্থায়িত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
এই পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট, সীমান্ত হত্যা এখনো বন্ধ হয়নি, বরং মাঝে মাঝে তা ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছায়। প্রতিটি ঘটনার পেছনে থাকে একটি পরিবার, একটি সমাজের কান্না, যাদের অভিযোগের সুর ভারতের অভ্যন্তরে খুব কমই প্রতিধ্বনিত হয়।
এই ধরনের ঘটনার ফলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের আবহে অস্বস্তি জন্ম নিচ্ছে। যদিও দুই দেশের সরকার বাণিজ্য, নিরাপত্তা, নদী ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগসহ বহু খাতে সহযোগিতার কথা বলে আসছে, তবু সীমান্ত হত্যা এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সবচেয়ে বড় কালো দাগ। বাংলাদেশ সরকারের নীরবতা কিংবা সীমিত প্রতিবাদ বারবারই নাগরিকদের মনে প্রশ্ন তোলে—সীমান্তে একজন বাংলাদেশির জীবন কি এতটাই মূল্যহীন?
ভারত একদিকে বলছে ‘অতি প্রয়োজন ছাড়া গুলি চালানো হবে না’, অন্যদিকে বাস্তবে দেখা যায় নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিককে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, কখনো গুলিতে ঝাঁঝরা করা হচ্ছে, কখনো মরদেহ গাছে ঝুলে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এর চেয়েও উদ্বেগজনক হলো, অধিকাংশ ঘটনায় কোনো বিচার হয় না, ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা।
সীমান্ত হত্যার এই অমানবিক ধারাকে বন্ধ করতে হলে দরকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে সত্যিকারের মানবিকতা ও সমতার মনোভাব প্রতিষ্ঠা করা। সীমান্তে হত্যার প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তথ্য প্রকাশ এবং কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ ছাড়া এই বন্ধুত্বের আবরণে লুকানো অসহিষ্ণুতা বন্ধ হবে না।
জাকারিয়ার মতো আরেকটি প্রানহানির ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু পররাষ্ট্র দপ্তরের চিঠি চালাচালিতে সীমাবদ্ধ থাকা নয়—বরং প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিশেষ করে যারা সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে সর্বদা ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে।
সীমান্তে আর কোনো মরদেহ গাছে ঝুলুক না—এটাই হওয়া উচিত দুই দেশের দায়িত্বশীল নেতৃত্বের অঙ্গীকার।
আপনার মতামত জানানঃ