নির্ধারিত আয় না থাকলেও আগের সরকার প্রতিবছর বড় আকারের বাজেট ঘোষণা করেছিল। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারের ব্যয়ের পরিমাণও বেড়েছে। এই অতিরিক্ত ব্যয় সামলাতে গিয়ে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিতে হয়েছে। আগস্ট ২০২৪-এ ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আশা ছিল যে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যয় হ্রাসে কঠোর হবে। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পরিচালন ব্যয় বেড়েছে ২৬ শতাংশ, যা আগের সরকারের ব্যয়ের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত দেয়।
বর্তমান বাজেট অনুযায়ী মোট ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষিত হয়েছিল, যার মধ্যে পরিচালন খাতে বরাদ্দ ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি এবং উন্নয়ন খাতে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। প্রথম নয় মাসে পরিচালন খাতে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৮৭ কোটি এবং উন্নয়ন খাতে ৭১ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এই সময়ের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা, যা পূর্ণ বাজেটের প্রায় ৪৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
প্রতিবছরের মতো এবারও অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যয়ের হার বাড়বে, বিশেষ করে জুন মাসে। পূর্ববর্তী দুই অর্থবছরেও বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেটের ৭৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছিল, আর ২০২২-২৩ সালে তা ছিল ৮৪ দশমিক ২১ শতাংশ।
খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ব্যয় বেড়েছে সাধারণ সরকারি সেবা খাতে, যেখানে ৭৫ দশমিক ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ খাতে অর্থ বিভাগের ব্যয় দ্বিগুণ হয়ে প্রায় ৬৯ হাজার ১৮০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। সুদের হার বৃদ্ধি ও মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে সরকারকে সুদ পরিশোধে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরে প্রথম ৯ মাসে সুদ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৯৬ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশি। এর বেশির ভাগই অভ্যন্তরীণ ঋণের বিপরীতে গিয়েছে।
ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের ড. সাজ্জাদ জহির জানিয়েছেন, আগের সরকারের ঋণের ভার বর্তমান সরকারকে বহন করতে হচ্ছে। সুদের হার বৃদ্ধির কারণে খরচ বেড়েছে এবং ঋণ কমানো না গেলে ভবিষ্যতে সুদের বোঝা আরও বাড়বে। পাশাপাশি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে সশস্ত্র বাহিনী মাঠে থাকায়, পুলিশ প্রশাসনে পরিবর্তন এবং সাবেক কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দান সরকারের ব্যয় বাড়িয়েছে। তবে এই চাপগুলো সময়ের সঙ্গে স্বাভাবিক হলে খরচ কিছুটা কমতে পারে।
শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ, কৃষিতে ১৫ শতাংশ এবং প্রতিরক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ। জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, পরিসংখ্যানই প্রমাণ করছে যে সরকারের ব্যয়ে কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। বাজেট বাস্তবায়নে প্রচলিত ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং মূল্যস্ফীতির প্রভাবেও কিছু খাতে খরচ বেড়েছে।
সার্বিকভাবে, অন্তর্বর্তী সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তেমন অগ্রগতি হয়নি। ঋণের চাপ এবং মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও কার্যকর খরচ হ্রাসের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
আপনার মতামত জানানঃ