বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক পালাবদলের পরিণতিতে যে অভূতপূর্ব চিত্র তৈরি হয়েছে, তাতে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের একটি নতুন অধ্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠজনদের ভারতের মাটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়া যেমন একটি মানবিক, তেমনি কূটনৈতিক বিষয়—তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরব অবস্থান গোটা ঘটনাকেই নতুন মাত্রা দিয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে জটিল। একদিকে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা, আরেকদিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ লেগেই আছে। শেখ হাসিনার সরকার দীর্ঘদিন ধরে ভারত-বান্ধব হিসেবে পরিচিত ছিল। বিশেষ করে দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপির সঙ্গে তার সরকারের সম্পর্ক ছিল দৃঢ়। এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতায়ই কি ভারতের মাটিতে হাসিনা ও তার অনুগত নেতাদের ঠাঁই মিলেছে? নাকি এর পেছনে আরও গভীর, সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ আছে—এই প্রশ্ন এখন সীমান্ত পেরিয়ে আলোচিত হচ্ছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ খোলার পর যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। কারণ এতদিন পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে মমতার তীব্র সমালোচনা দেখা গেলেও, প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক পলাতকদের আশ্রয় নিয়ে এই প্রথম তিনি এত সরাসরি কথা বললেন। “ভারত সরকার কিছু অতিথিকে সরকারি অতিথি হিসেবে রেখেছে”—এই বক্তব্য শুধু ভারতের কেন্দ্রীয় নীতির প্রতি তাঁর আস্থাহীনতাই নয়, বরং বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকেও স্পষ্ট করে।
এই বক্তব্যের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, তিনি বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সরকারকে “গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত” হিসেবে পরোক্ষভাবে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ, তিনি শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের শরণার্থী নীতির সমালোচনা করেননি, সেইসঙ্গে বাংলাদেশের ‘জুলাই আন্দোলন’ এবং শেখ হাসিনার ভূমিকা নিয়েও তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, মমতার এই অবস্থান এককভাবে শুধু তার রাজ্য রাজনীতির ফ্রেমওয়ার্কে বিশ্লেষণ করা যাবে না। এটি আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং বাংলাদেশে নতুন করে রাজনৈতিক ভারসাম্য রচনার এক অনুঘটক হয়ে উঠতে পারে। কারণ যদি পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্পষ্টতই এইসব পলাতকদের তাড়ানোর উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা শুধু ভারত সরকারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকেই প্রকাশ করবে না, বাংলাদেশে নতুন উদীয়মান নেতৃত্বের প্রতি একটি ‘নৈতিক সমর্থন’-এর ইঙ্গিতও বহন করবে।
অন্যদিকে, ভারতের মাটিতে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের অবস্থান ও প্রচার কার্যক্রম চলতে থাকলে তা দুই দেশের জনগণের মধ্যে একধরনের অসন্তোষের জন্ম দিতে পারে। এমনিতেই বাংলাদেশের জনগণ গত এক দশকের বেশি সময় ধরে নির্বাচনহীনতা, গুম, খুন, ও দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ‘জুলাই আন্দোলন’-এর মাধ্যমে সেই ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়েছে, এবং জনগণ চায় বিচারের মুখোমুখি হোক দোষীরা। সেখানে ভারতের ভূমিকা যদি “নিরাপদ আশ্রয়দাতা”র মতো হয়ে ওঠে, তাহলে তা জনমতকে ভারতে-বিরোধী করে তুলতেও পারে।
ভারতের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। একদিকে তারা গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলে, অন্যদিকে একটি দমনমূলক সরকারের নেতাদের আশ্রয় দিলে সেটা আন্তর্জাতিক মহলে দ্বিচারিতা হিসেবে দেখা যেতে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কে।
এদিকে কিছু ভারতীয় মিডিয়ায় যেভাবে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের সাক্ষাৎকার প্রচার করা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে দিল্লির একাংশ এখনো তাদের সঙ্গে একটি সম্ভাব্য ‘পলিটিক্যাল রিইনস্টলেশন’-এর চিন্তা করছে। তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে সেই সমীকরণ ভেঙে যেতে পারে।
সবশেষে, মমতার অবস্থান শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এক ধরনের বার্তা। কেন্দ্রীয় সরকারকে অবহিত করিয়ে দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন—ভারত শুধু দিল্লি নয়, ভারত মানে মমতার বাংলাও। আর এই বাংলা চায় না, তার ভূমিতে লুকিয়ে থাকুক অন্য দেশের স্বৈরশাসকরা। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস মুক্তির ইতিহাস, গণতন্ত্রের ইতিহাস। সেখানে আশ্রয় পাবে না কোনো ফ্যাসিস্ট।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে—বাংলাদেশের সাবেক শাসকদের আশ্রয় দিয়ে ভারত কী কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করছে, না কি ভবিষ্যতের রাজনীতির মঞ্চ তৈরি করছে? আর মমতা যেভাবে উচ্চারণ করলেন—“আমি তো কিছু বলিনি”—সেটা হয়তো এই অঞ্চলের রাজনীতির গভীর বাস্তবতা তুলে ধরার এক নতুন ভাষ্য।
আপনার মতামত জানানঃ