গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পূর্বঘোষিত সমাবেশকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক সহিংসতা দেশের রাজনীতি ও মানবাধিকার বাস্তবতার একটি উৎকট প্রতিচ্ছবি। ১৬ জুলাইয়ের ওই ঘটনায় প্রাণ হারান পাঁচজন, আহত ও গ্রেপ্তার হন বহু মানুষ। হামলার ভয়াবহতা ও তার প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণে এগিয়ে আসে ১১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের একটি পর্যবেক্ষণ দল, যারা সরেজমিনে গিয়েছিলেন গোপালগঞ্জে। তাঁরা তাদের পর্যবেক্ষণে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন, সেখানে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের যৌক্তিকতা তাঁরা পাননি। একইসঙ্গে তাঁরা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দমনমূলক আচরণের বিষয়গুলো নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
ঘটনার শুরু থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য, হুমকি ও ঘৃণামূলক পোস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছিল। একদিকে এনসিপির কিছু নেতার ‘টুঙ্গিপাড়ার কবর ভাঙা’, ‘হাতুড়ি’ বা ‘ভেকু’ ব্যবহার সংক্রান্ত বক্তব্য, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ (যাদের কার্যক্রম বর্তমানে নিষিদ্ধ) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ‘যেকোনো মূল্যে সমাবেশ ঠেকানো’ বা ‘নেতাদের ফেরত না যাওয়ার হুমকি’ উসকানিকে আরও জটিল করে তোলে। গোপালগঞ্জ শহরের সাধারণ জনগণ, স্থানীয় সাংবাদিক, প্রশাসনের সদস্য ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই উত্তেজনাকর পরিবেশ সমাবেশের আগেই সংঘর্ষের পূর্বাভাস দিয়েছিল।
সমাবেশ শুরুর আগেই গোপালগঞ্জ শহরে ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি সংঘবদ্ধ দল মঞ্চ ভাঙচুর করে, পুলিশ ও ইউএনওর গাড়িতে হামলা চালায় এবং শহরের প্রবেশপথে গাছ ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। পুলিশ শুরুতে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করলেও পরে তা শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করে। এই গুলির কারণেই প্রাণহানি ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের মত। তবে যেসব ‘জনতা’ হামলা চালায়, তাদের মধ্যে কেউ গুলি করেছে কি না—তা কেউ প্রত্যক্ষ করেনি, যদিও ককটেল বিস্ফোরণ ও দেশীয় অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহারের কথা সবাই বলেছেন।
পর্যবেক্ষণ দলের বিবৃতিতে নিহতদের মধ্যে দীপ্ত সাহা, ইমন ও রমজান কাজীর মৃত্যুর বিবরণ বিশেষভাবে উঠে এসেছে। সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী, দীপ্ত নিরস্ত্র ছিলেন, ইমন অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং ঊরুতে গুলিবিদ্ধ হয়েও প্রাণ হারান, আর রমজানকে দৌড়ে পালাতে গিয়ে পড়ে গেলে পিঠে গুলি করা হয়। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্ভাবনা প্রবল। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই ঘটনায় প্রায় ১০ হাজারের বেশি মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং শিশুদের পর্যন্ত সন্ত্রাস দমন আইনে গ্রেপ্তার করে যশোর শিশু সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে।
সরকার যে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করেছে, তার সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর সদস্য, যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। এই বাস্তবতায় কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। কমিশনের কার্যপরিধিতেও নেই সেনাবাহিনীর গুলিতে হতাহতের বিষয় তদন্তের নির্দেশ। পর্যবেক্ষণ দল মনে করে, এমন একটি কমিশন কোনো কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য তদন্তে সক্ষম নয়। তাঁরা তাই কমিশন পুনর্গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন।
পর্যবেক্ষণ দলে থাকা বিশিষ্টজনেরা মনে করেন, প্রশাসনের প্রস্তুতির অভাব ও পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধিতে ঘাটতির কারণে সংঘর্ষ এতটা ভয়াবহ রূপ নেয়। আগে থেকেই সেনা মোতায়েন বা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রস্তুতি থাকলে হয়তো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার ছাড়াই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো। উপরন্তু, প্রশাসন এনসিপিকে আগে থেকেই বিপদ সম্পর্কে অবহিত করেনি, ফলে নেতারাও নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কা গুরুত্ব দিয়ে নেননি। আর তাই সমাবেশের পর গাড়ি বহর নিয়ে বের হওয়ার সময় তাঁদের ওপর ব্যাপক হামলা হয়, যার একমাত্র নিয়ন্ত্রণ কৌশল হয়ে দাঁড়ায় গুলি চালানো।
গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন সাক্ষ্যের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ দল যে বিবৃতি দিয়েছে, তা মূলত একটি প্রগতিশীল ও মানবাধিকারসম্মত রাষ্ট্রের জন্য অ্যালার্ম বেল। তাঁরা চান, সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ করার অধিকার নিশ্চিত হোক, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধ হোক, রাষ্ট্র যেন দমনমূলক আচরণ না করে, আর নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়। তাঁরা মানবাধিকার কমিশনকে আরও কার্যকর ও স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।
গোপালগঞ্জের ঘটনাটি নিছক একটি রাজনৈতিক সহিংসতা নয়; এটি রাষ্ট্র, প্রশাসন ও রাজনীতির সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রকাশ। একটি দল সমাবেশ ডেকেছিল, অপর পক্ষ তা প্রতিহত করতে মরিয়া হয়েছিল, আর প্রশাসন তা সামলাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এই ব্যর্থতার খেসারত দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে—নিহতদের পরিবারকে, গ্রেপ্তার হওয়া শিশুদের ভবিষ্যৎকে, আর গণতন্ত্রের অস্তিত্বকে। এখন সময় এসেছে, সরকার যদি সত্যিই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে, তবে নিরপেক্ষ তদন্ত, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন এবং রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা নিশ্চিত করতেই হবে। নয়তো গোপালগঞ্জ আমাদের রাষ্ট্রীয় পঙ্গুত্বের এক স্থায়ী প্রতীক হয়ে থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ