পবিত্র কোরআনের হাফেজ, অথচ গাজার জন্য একটি বাক্যও উচ্চারণ করেন না। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তির নোবেলের জন্য মনোনয়ন দেন। তিনি পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান—ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। কাগজে-কলমে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বড় সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদে থাকা এই ব্যক্তির নীরবতা শুধু দুর্বলতা নয়, এটি এক ধরনের যৌথ ভণ্ডামির প্রতীক।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই নিজেকে মুসলিম উম্মাহর রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছে। পদক ঝোলানো বীরদের পেছনে ক্ষেপণাস্ত্রের প্রতীক, কায়দামতো সাজানো কোরআন পাঠ—সব মিলিয়ে একটি আবেগনির্ভর শাসনের নৈতিক মুখোশ। কিন্তু এই মুখোশ খসে পড়ে যখন গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে ফিলিস্তিনিরা মারা যায়, আর পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব কেবল ‘গভীর উদ্বেগ’ জানিয়ে বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে।
মূল সমস্যা আদর্শগত নয়, বরং রাজনৈতিক দাসত্বে আবদ্ধ। পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে শীর্ষ জেনারেলদের অনেকেই দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে এসেছেন। সেখানেই শেখা হয় শুধু যুদ্ধকৌশল নয়, শেখা হয় সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখার পাঠ—ওয়াশিংটনের নির্দেশ মানা, তেল আবিবের প্রতি নম্রতা দেখানো, এবং পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে কোনো প্রকৃত প্রতিরোধকে ঘৃণা করা। দেশে ফিরে তাঁরা হয়ে ওঠেন সামরিক ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি ম্যানেজার’—যাঁদের সার্বভৌমত্ব বলে কিছু নেই, আছে কেবল বিদেশি পৃষ্ঠপোষকদের মন জয়ের প্রয়াস।
ফিলিস্তিন সংকট তাই পাকিস্তানের জন্য শুধু কূটনৈতিক বিবৃতি ও আন্তর্জাতিক স্টেটমেন্টের বিষয়। সেনাবাহিনী বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেয় না, নেয় না কোনো প্রতীকী প্রতিরোধও। একটা মেডিকেল ইউনিট পাঠানো, ইসরায়েলি কোম্পানির পণ্য বর্জন কিংবা মিসর সীমান্তে ত্রাণ পাঠানোর মতো ন্যূনতম পদক্ষেপও নেওয়া হয় না। কারণ, এই জেনারেলরা ভালো করেই জানেন—ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অবস্থান মানে ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে যাওয়া। যা তাঁদের কাছে একেবারে অকল্পনীয়।
এখানে আসিম মুনির কেবল একটি উপসর্গ। ব্যাধিটি পাকিস্তানের সামরিক শীর্ষপর্যায় জুড়ে। এ এক জায়োনিজম—ইসরায়েলি রকমের নয়, বরং নীরবতা আর মুনাফালোভী মনোভাবের জায়োনিজম। যেখানে সাম্য, ন্যায়বিচার বা উম্মাহর সম্মিলিত বোধের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় IMF-এর ঋণপ্যাকেজ, কিংবা পেন্টাগনের প্রশংসা। যেখানে গাজার শিশুর মৃত্যু হয়, আর সেনা ব্যারাকে বাজে সিলেবাসভিত্তিক দেশপ্রেমের গান।
বিপরীতে, যখন কাশ্মীর ইস্যুতে সামান্য উত্তেজনা তৈরি হয়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বুক ফুলে ওঠে। বিমান ওড়ে, পতাকা নাড়ে, আইএসপিআর দেশপ্রেমে ভরা ভিডিও তৈরি করে। জনগণকে বোঝানো হয়, তারা জাতির গর্ব, মুসলিম বিশ্বের আশার প্রতীক। কিন্তু যখন গাজা পুড়ে ছাই হয়, হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন সেই বাহিনী একেবারেই নিরব, নিস্পৃহ। এক ধরনের উদ্দেশ্যমূলক ‘কৌশলগত সংযম’ পালন করে।
এই দ্বৈতনীতি শুধু কাপুরুষতা নয়, এটি প্রতারণাও। এটি সেই পরিহাস, যেখানে পাকিস্তানের জনগণকে ধর্মীয় আবেগে ব্যবহার করে এক সামরিক অভিজাত শ্রেণি, যারা আদতে পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকে।
আরও ভয়াবহ বাস্তবতা হলো, এই সামরিক নেতৃত্ব ইসরায়েলের মধ্যে নিজেদেরই প্রতিবিম্ব খুঁজে পায়। যে সেনাবাহিনী ঘরে গণতন্ত্রকে দমন করে, ভিন্নমতের সাংবাদিককে গুম করে, নির্বাচনকে প্রভাবিত করে—তাদের জন্য গাজায় ইসরায়েলের বর্বরতা নয়, বরং তা একধরনের ‘কৌশলগত অনুপ্রেরণা’ হয়ে ওঠে। হয়তো এই কারণেই তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ইসরায়েলঘেঁষা পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ব্যবস্থাপনার’ কৌশল শিখতে যান—ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, বরং নিপীড়নকে আরও সূক্ষ্মভাবে চালানোর জন্য।
এভাবে ধীরে ধীরে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী রূপ নিচ্ছে এক ‘পিআর-চালিত’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে, যারা সত্যিকারের যুদ্ধ নয়, বরং ইমেজ ম্যানেজমেন্টে ব্যস্ত। গাজার নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো ন্যূনতম সাহসও নেই তাঁদের। আছে শুধু নিরবতা, আর সেই নিরবতাকেই পুঁজি করে পশ্চিমাদের কাছ থেকে আরও সামরিক সহায়তা কামনা।
পাকিস্তানের জনগণ অবশ্য এতটা নির্বোধ নন। করাচি থেকে খাইবার—সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছেন, ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে নিয়েছেন, নিজেদের সামান্য সঞ্চয়ও দিয়েছেন ত্রাণের জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন এক শ্রেণি, যাঁদের চোখে ফিলিস্তিন একটি ‘পিআর সমস্যা’, আর পেন্টাগন একমাত্র অভিভাবক।
যত দিন পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব এই ঔপনিবেশিক আনুগত্য ঝেড়ে না ফেলবে, তত দিন এই বাহিনীর উঁচু পদ—‘চিফ অব আর্মি স্টাফ’, ‘ফিল্ড মার্শাল’, ‘স্ট্র্যাটেজিক কমান্ড’—সবই হয়ে থাকবে এক কাপুরুষতার পদবি। এসব উপাধি হয়তো পশ্চিমা মঞ্চে সম্মান পাবে, কিন্তু ইতিহাসের ন্যায়ের আদালতে এদের ঠাঁই হবে ঘৃণার তালিকায়।
এবং যখন ভবিষ্যতের কোনো গাজা আবার পুড়বে, তখন এই নিরবতার ইতিহাসই হয়ে থাকবে পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের চূড়ান্ত পরিচয়।
আপনার মতামত জানানঃ