গাজা উপত্যকা যেন এখন এক চলমান গণকবর। দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে রক্তে রঞ্জিত হয়েছে প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি ভবন, প্রতিটি শিশুর মুখ। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই বর্বর অভিযানে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫৭ হাজার ৫২৩ জন মানুষ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নিহতদের বড় অংশই নারী ও শিশু। যুদ্ধের নৃশংসতা কেবল যোদ্ধাদের গায়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি—সাংবাদিক, চিকিৎসক, ত্রাণকর্মী ও সাধারণ স্বেচ্ছাসেবকও এর শিকার হয়েছেন।
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে আরও ১০৫টি মৃতদেহ। আহত হয়েছেন আরও ৩৫৬ জন। এই নিয়ে আহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৭ জনে। এর বাইরে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা অনেকের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা এখনো অজানা।
২০২৫ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া নতুন দফার হামলায় গত কয়েক মাসেই প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজার ৯৬৪ জন, আহত হয়েছেন ২৪ হাজার ৫৭৬ জন। এটি প্রমাণ করে যে সাময়িক যুদ্ধবিরতি কিংবা বন্দী বিনিময়ের মতো উদ্যোগগুলো স্থায়ী শান্তি আনতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। বরং যুদ্ধবিরতির অবসান মানেই নতুন করে বোমা বর্ষণের সূচনা।
আন্তর্জাতিক মহল অনেকবার উদ্বেগ প্রকাশ করলেও কার্যত কোনো ফল আসেনি। গত বছর নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। তবুও ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। বরং নতুন নতুন সামরিক হামলা এবং অবরোধের মাত্রা বেড়েছে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা এখনো চলমান। দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্যোগে দায়ের করা এই মামলায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি ‘জাতিগত নিধন’-এর অভিযোগ আনা হয়েছে। গাজায় যা ঘটছে, তা কেবল একটি দেশের ভূখণ্ড দখলের লড়াই নয়—এটি এখন মানব সভ্যতার চরম লজ্জা ও ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাজার সাধারণ মানুষ। যাদের অনেকেই ঘরহারা, খাবারহীন ও চিকিৎসা সেবার বাইরে। জাতিসংঘের হিসেবে, গাজার মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই এখন মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। যুদ্ধের কারণে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। শিশুরা শিক্ষা হারিয়েছে, মা-বাবা হারিয়েছে, স্বপ্ন হারিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধ্বংসযজ্ঞের মূল কারণ একদিকে যেমন ভূরাজনৈতিক স্বার্থ, তেমনি পশ্চিমা শক্তিগুলোর নীরব সমর্থন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা একদিকে যুদ্ধবিরতির কথা বললেও, অন্যদিকে ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। এই দ্বিচারিতা বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
গাজা এখন আর শুধুই একটি অঞ্চল নয়; এটি প্রতিরোধের প্রতীক, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। বিশ্বের বিবেকবান মানুষ, মানবাধিকার সংস্থা ও নিরপেক্ষ মিডিয়াগুলোর ওপর দায়িত্ব এখন সত্য প্রকাশ ও চাপ সৃষ্টি করার। কারণ প্রতিটি দিন বিলম্ব মানে আরও প্রাণহানি, আরও শোক, আরও ধ্বংস।
গাজায় এখন যা প্রয়োজন তা হলো অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া এবং দোষীদের আন্তর্জাতিক বিচারের আওতায় আনা। নইলে এই মানবিক বিপর্যয় আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, যার দায় শুধু ইসরায়েলের নয়, নীরব থাকা গোটা বিশ্বের।
আপনার মতামত জানানঃ