ঈদুল আযহার দিন গাজাজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৪২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে আল জাজিরাকে জানিয়েছেন চিকিৎসা সূত্রগুলো। একই সঙ্গে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF) জানিয়েছে, নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের সমস্ত ত্রাণকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে।
স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শুক্রবার দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহরের নাসের হাসপাতালে ১৬টি মরদেহ পৌঁছেছে। একই সংখ্যক মৃতদেহ পৌঁছেছে উত্তর গাজার আল-শিফা হাসপাতালে। গাজা সিটির আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালে ৫ জন এবং দেইর আল-বালাহর আল-আকসা শহীদ হাসপাতালে আরও ৫ জনের মরদেহ পাঠানো হয়েছে।
আল জাজিরার প্রতিবেদক তারেক আবু-আজম, যিনি দেইর আল-বালাহ থেকে প্রতিবেদন দিচ্ছিলেন, বলেন, “এভাবেই গাজায় ঈদ পালিত হচ্ছে।” তিনি বলেন, এই দিনটি আনন্দের দিন হওয়ার কথা থাকলেও, বাস্তবে তা “একটি বেদনাদায়ক স্মৃতি—তারা কী হারিয়েছে এবং কীভাবে দুঃসহ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার লড়াই করছে”।
এদিকে, বৃহস্পতিবার আল-আহলি হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলায় আহত এক সাংবাদিক শুক্রবার মারা যান। গাজার সরকার পরিচালিত মিডিয়া অফিস জানায়, এর ফলে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ২২৬ জনে পৌঁছেছে।
মিডিয়া অফিসটি বিশ্বের সকল সাংবাদিক সংগঠনকে এই “পদ্ধতিগত হত্যা”র নিন্দা জানাতে আহ্বান জানিয়ে বলেছে, “আমরা সাংবাদিকদের হত্যা বন্ধ করতে এবং গাজা উপত্যকার সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কার্যকর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানাচ্ছি।”
একই দিন খান ইউনিসে একটি বোমা পুঁতে রাখা ভবনে বিস্ফোরণে চারজন ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর একটি প্রাথমিক তদন্ত। এই সপ্তাহের শুরু থেকে গাজায় নিহত ইসরায়েলি সেনার সংখ্যা আটজনে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন আল জাজিরার হামদাহ সালহুত।
এই মৃত্যুগুলো এমন সময়ে ঘটছে যখন গাজায় মানবিক সহায়তা বিতরণের দায়িত্বে থাকা মার্কিন-সমর্থিত GHF জানিয়েছে, তাদের সমস্ত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।
GHF জানিয়েছে, “মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা যেন এখন ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের আশেপাশে না আসে।” গত সপ্তাহে কাজ শুরু করা GHF তাদের ফেসবুক পেজে শুক্রবার জানায়, কেন্দ্রগুলো পুনরায় কখন খোলা হবে সে বিষয়ে পরে জানানো হবে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকে সহিংস ঘটনার পরই GHF-এর কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে কয়েকজন ত্রাণ প্রত্যাশী নিহত হলে কেন্দ্রে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার মাত্র দুটি কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণ করা হয়।
রবিবার ভোর হওয়ার অনেক আগেই হাজার হাজার মানুষ ত্রাণ কেন্দ্রে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেসময় ইসরায়েলি বাহিনী তাদের ছত্রভঙ্গ হয়ে পরে আসার নির্দেশ দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, যখন তারা ফ্ল্যাগ রাউন্ডআবাউটে পৌঁছায়, তখন ইসরায়েলি বাহিনী গুলি চালায়।
“চারপাশ থেকে গুলি আসছিল—নৌযান, ট্যাংক ও ড্রোন থেকে,” বলেন উপস্থিত থাকা আমর আবু তাইবা।
গাজার খান ইউনিসের একজন সার্জন গওহার রাহবোর আল জাজিরাকে বলেন, রবিবার ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে গুলিবিদ্ধ রোগীদের দেহ থেকে যেসব গুলি বের করা হয়েছে, তা ছিল এম১৬ রাইফেলের, যা ইসরায়েলি বাহিনীর ব্যবহৃত অস্ত্রের সঙ্গে মিলে যায়।
“আমি দুই রোগীর অপারেশন করেছি এবং তাদের পেট থেকে এম১৬ গুলি বের করেছি,” বলেন রাহবোর। “তারা আমাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, গাজার হাসপাতালগুলো চরম সংকটে রয়েছে—অ্যান্টিবায়োটিক, তুলা, অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি—সব কিছুরই ঘাটতি চলছে।
GHF-এর ত্রাণ বিতরণ পদ্ধতি নিয়ে জাতিসংঘসহ বহু মানবিক সংস্থা কড়া সমালোচনা করেছে।
GHF দাবি করেছে, তাদের কেন্দ্রে নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীরা ভিড়ের দিকে গুলি চালায়নি।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী স্বীকার করেছে, পূর্ববর্তী ঘটনায় তারা সতর্কতামূলক গুলি চালিয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার জানায়, ইসরায়েলের এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত অন্তত ৫৪,৬৭৭ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১,২৫,৫৩০ জন আহত হয়েছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে চালানো হামলায় ইসরায়েলে আনুমানিক ১,১৩৯ জন নিহত হন এবং ২০০ জনেরও বেশি বন্দী হন।
বৃহস্পতিবার কাতার ও মিসর জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত এক প্রস্তাবের ভিত্তিতে ৬০ দিনের অস্ত্রবিরতির মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে আবারও চেষ্টা শুরু করেছে। এর আওতায় গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশের সুযোগ রাখা হয়েছে।
তবে ইসরায়েল পূর্বের বিভিন্ন আলোচনা পর্বে যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বন্ধ এবং বাহিনী সম্পূর্ণ প্রত্যাহার সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি থেকে পিছু হটায় আগের অস্ত্রবিরতির উদ্যোগগুলো ব্যর্থ হয়েছে।
গাজা উপত্যকায় চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত—ঈদুল আজহার দিন ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় কমপক্ষে ৪২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হওয়া—বিশ্ববাসীর হৃদয় বিদীর্ণ করেছে। এই নৃশংসতার পেছনে যে একটি বড় রাজনৈতিক ছায়া রয়েছে, সেটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় ও অবিচল সমর্থন ইসরায়েল সরকারের প্রতি। প্রশ্ন উঠছে—এই সমর্থন কি শুধু কূটনৈতিক ও আর্থিক সীমাবদ্ধ? নাকি এটি মানবিক বিপর্যয়ে পরোক্ষ সহঅপরাধে রূপ নিচ্ছে?
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক সাহায্যপ্রাপ্ত দেশ। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের সময় একটি ১০ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় ইসরায়েলকে ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সামরিক সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বছরে গড়ে ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র, প্রযুক্তি এবং গোয়েন্দা সহায়তা পেয়ে থাকে ইসরায়েল।
এই সহায়তার ফলেই ইসরায়েল গাজায় ব্যবহার করছে উন্নত প্রযুক্তির বোমা, ড্রোন, এবং যুদ্ধযান—যা রক্তপাতের মাত্রাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। ঈদের দিন যেসব বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং অসংখ্য নিরস্ত্র মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, তা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া অস্ত্রের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে বলেই মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF) নামে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত একটি ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থা সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে। সংস্থাটি গাজায় ত্রাণ বিতরণের দায়িত্বে থাকলেও নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগে এর সব কেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। এর ফলে খাদ্য, ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর তীব্র সংকট আরও বেড়েছে।
GHF-এর আশপাশেই বারবার সহিংসতা ঘটছে, ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে সাধারণ ফিলিস্তিনি ত্রাণপ্রত্যাশীরা নিহত হচ্ছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এই সংস্থার অপারেশনাল ব্যর্থতা এবং তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা একটি নতুন রকমের মানবিক সংকট তৈরি করছে—যেখানে ত্রাণের আড়ালে চলছে সংঘাতের এক অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ।
যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে বারবার ইসরায়েলবিরোধী প্রস্তাব ভেটো করে এসেছে। ইসরায়েলের “আত্মরক্ষার অধিকার” নামে যে কূটনৈতিক ঢাল যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করে, তা বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলিকে আড়াল করে রাখে। যেমন, গাজায় একটি হাসপাতাল লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ হলে যুক্তরাষ্ট্র তা নিন্দা করলেও, প্রতিক্রিয়ায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয় না। বরং ইসরায়েলের অবস্থানকেই সমর্থন করে।
বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে মানবিক বিপর্যয়ের সময় যুক্তরাষ্ট্র যতটা সোচ্চার ভূমিকা নেয়—তবে ফিলিস্তিনি জনগণের ক্ষেত্রে সে ভূমিকা তেমন দেখা যায় না। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যেমন কঠোর নিষেধাজ্ঞা, সামরিক সহায়তা এবং ন্যাটোর সক্রিয়তা দেখা গেছে, গাজায় তেমন কোনো দৃঢ়তা দেখা যায় না। বরং এখানে এক ধরনের নৈতিক দ্বিচারিতা লক্ষ্য করা যায়—যেখানে মানুষের জীবনহানির মূল্য ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মাপা হয়।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কোনো দেশ যদি জানে যে তার দেওয়া অস্ত্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে ব্যবহৃত হবে, এবং তবুও সে সহায়তা চালিয়ে যায়, তাহলে তা সহঅপরাধে গণ্য হতে পারে। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে শিশু, নারী এবং সাংবাদিকদের মৃত্যুর ঘটনাগুলি যখন প্রতিনিয়ত সামনে আসছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের এই অবিচল সমর্থনকে অনেকেই নৈতিক বা আইনি সহঅপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করছেন।
বর্তমানে কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় একটি ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চলছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রও একটি প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—একদিকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান আর অন্যদিকে যুদ্ধযন্ত্রের জ্বালানি সরবরাহ—এই দ্বৈত ভূমিকা শান্তি প্রক্রিয়াকে কতটা কার্যকর করতে পারবে?
গাজায় চলমান সংকট শুধু একটি যুদ্ধ নয়, এটি একটি বৃহৎ মানবিক বিপর্যয়—যেখানে একটি শিশু প্রতিদিন বোমার শব্দে ঘুম ভাঙে, একটি মা তার সন্তানের মৃতদেহ খুঁজে বেড়ায়, এবং একটি জাতি তার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা শুধু সমর্থকের নয়, বরং ঘটনার নেপথ্য শক্তি হিসেবেও বিবেচ্য। আজ যদি বিশ্ব নীরব থাকে, তবে ইতিহাস এই নীরবতাকেও অপরাধ বলেই গণ্য করবে।
আপনার মতামত জানানঃ