একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। উড্ডয়নের ১২ মিনিটের মাথায় সেটি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে ঢাকার উত্তরা এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি দোতলা ভবনের ওপর। মুহূর্তেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আগুন, ধোঁয়া আর আতঙ্ক। স্কুলে তখন ছুটি হয়ে গিয়েছিল, কিছু শিক্ষার্থী বেরিয়ে গিয়েছিল, কেউ কেউ ভবনের ভেতরে ছিল। কেউ বেরিয়ে এসেছিল, কেউ আটকা পড়েছিল, কেউ মরে গিয়েছিল আগুনের লেলিহান শিখায়। বিকেল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যা বাড়তে থাকে—নিহত ২০, আহত ১৭১। আগুনে পুড়ে যাওয়া অধিকাংশই স্কুলপড়ুয়া কিশোর। কারও দুই হাত, কারও মুখ, কারও গোটা শরীর পুড়ে যায়। একেকজনের বয়স ১০ থেকে ২০-এর মধ্যে। হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করে তারা—যারা বেঁচে আছে।
আইএসপিআর জানিয়েছে, বিমানটি ছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই মডেলের একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। সোমবার (২১ জুলাই) দুপুর ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলার ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে সেটি। মাত্র ১২ মিনিটের মাথায়, ১টা ১৮ মিনিটে সেটি যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়ার পর বিধ্বস্ত হয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম সেটি জনবিরল এলাকায় নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেটি গিয়ে পড়ে একটি স্কুল ভবনের ওপর। নিজেও প্রাণ হারান পাইলট তৌকির। তাঁর এই আত্মোৎসর্গের প্রচেষ্টা হয়তো আরও বড় বিপর্যয় এড়িয়েছে, কিন্তু যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটি কোনোভাবেই ছোট নয়।
ঘটনাস্থলে কিছুক্ষণ পরেই পৌঁছে যায় সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, ও বিমানবাহিনীর উদ্ধারকারী দল। ৮টি ইউনিট কাজ শুরু করে আগুন নেভাতে ও আহতদের বের করে আনতে। হেলিকপ্টারে করে সিএমএইচে নেওয়া হয় দগ্ধদের, একে একে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট, কুর্মিটোলা, ঢাকা মেডিকেল, উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল, লুবনা জেনারেল, সিএমএইচ এবং আরও কয়েকটি হাসপাতালে।
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটেই চিকিৎসা নিচ্ছে সবচেয়ে বেশি আহত—৭০ জন। তাদের মধ্যে অনেকেই দগ্ধ, কারও শরীরের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। একইসঙ্গে নিহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন—যার মধ্যে শুধু সিএমএইচেই ১২ জন। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক, বার্ন ইউনিট, লুবনা হাসপাতাল মিলিয়ে গড়পড়তায় দগ্ধ, আহত, মৃত মিলিয়ে ভয়ংকর এক মানবিক বিপর্যয়ের চিত্রই ফুটে উঠেছে।
এ ঘটনায় শোক জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা। শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেছেন, “এই ঘটনায় ভালো রকমের তদন্ত হবে। আমরা আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করবো, কোনো গাফিলতি হবে না।” একই সঙ্গে জাতীয় বার্ন ইউনিটে ছুটে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল, জামায়াত আমির শফিকুর রহমান, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খানসহ অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা। হাসপাতালের সামনে তৈরি হয় উপচে পড়া ভিড়।
অনেকে এখনও নিখোঁজ। স্কুলের সামনে ছুটে আসা মা-বাবারা সন্তানদের খোঁজে পাগলপ্রায়। কেউ বলছে, বড় ছেলেকে পেয়েছি, ছোটটা এখনও ভেতরে। কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছেন বলেই, “ওর দুই হাত আর মুখ পুড়ে গেছে, বাঁচবে তো?” মিলিটারি রেস্কিউ ব্রিগেড, হাসপাতালগুলো এবং পুলিশের ইমার্জেন্সি সেল হটলাইন চালু করেছে—যাতে পরিচয়হীন বা নিখোঁজদের খোঁজ মিলতে পারে। যাদের দেহ শনাক্ত করা যাবে না, তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে।
বিমানটি কেন দুর্ঘটনার শিকার হলো, তা এখনও পরিষ্কার নয়। আইএসপিআর বলছে, বিস্তারিত তদন্ত ছাড়া কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগেও বাংলাদেশে সামরিক বা প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েকবার, কিন্তু জনবহুল স্কুলে এভাবে একটি যুদ্ধবিমান পতনের ঘটনা নজিরবিহীন।
প্রশিক্ষণ চলাকালে এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান কি এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ? বিমান উড্ডয়ন ব্যবস্থাপনায় কি ছিল কোনো গাফিলতি? প্রযুক্তিগত ত্রুটি আগে ধরা পড়েছিল কি না? এসব প্রশ্ন উঠছে এখন।
এখন দেশের শোকের দিন। মঙ্গলবার একদিনের জন্য রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় পতাকা থাকবে অর্ধনমিত। সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রার্থনা হবে নিহতদের আত্মার শান্তির জন্য।
কিন্তু কোনো রাষ্ট্রীয় শোক কি ফিরিয়ে দিতে পারে একটি ১৪ বছর বয়সী স্কুলছেলেকে, যার মুখটা আগুনে ঝলসে গেছে? কোন পতাকা নেড়ে থামানো যাবে সেই সব মায়ের কান্না, যাদের সন্তান সকালে স্কুলে গিয়ে আর ফিরে আসেনি? এই শোক, এই ক্ষত হয়তো থেকে যাবে বাংলাদেশের হৃদয়ে—আরও অনেক দিন।
আপনার মতামত জানানঃ