বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গন সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এবং সাবেক সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার প্রকাশ্যে দাবি করেছেন—বর্তমান সরকারের আটজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে তাঁর কাছে সীমাহীন দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। এই অভিযোগ শুধু নামহীন ও সাধারণ অভিযোগ নয়; বরং তিনি সভায় উপস্থিত প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সামনে বলেছেন, গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও এই প্রমাণ আছে, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
ঘটনার শুরু রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও আগামী দিনের জনপ্রশাসন’ শীর্ষক এক সেমিনারে। উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও সংসদ সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ আমলারা। আলোচক হিসেবে বক্তব্য দিতে গিয়ে আব্দুস সাত্তার প্রকাশ করেন তাঁর হতাশা—একজন উপদেষ্টার এপিএসের অ্যাকাউন্টে নাকি ২০০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে, অথচ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়া তিনি প্রশ্ন তোলেন, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো কেন অনভিজ্ঞ উপদেষ্টাদের হাতে দেওয়া হয়েছে।
এই বক্তব্যের খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয় তুমুল আলোচনা ও সমালোচনা। পরের দিনই সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ লিখিত বিবৃতিতে অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ আখ্যা দেন এবং সাত্তারকে আহ্বান জানান—যদি তাঁর কাছে কোনো প্রমাণ থাকে তবে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে। সরকারের দাবি, বর্তমান প্রশাসন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ, তাই ঢালাও অভিযোগ দায়িত্বজ্ঞানহীন ও জনআস্থার জন্য ক্ষতিকর।
বিএনপিও দলীয়ভাবে এই বক্তব্য থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রকাশ্যে জানান, এই অভিযোগের দায় সম্পূর্ণ সাত্তারের ব্যক্তিগত, দলের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি প্রধান উপদেষ্টা ও সরকারের উপদেষ্টাদের সততা ও নৈতিকতার ওপর আস্থা প্রকাশ করেন।
তবে সাত্তার অভিযোগ প্রত্যাহার করেননি। অভিযোগ ওঠার পর থেকে তাঁর ফোন বন্ধ থাকায় গণমাধ্যম যোগাযোগ করতে পারেনি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এই নীরবতা এখন মূল প্রশ্ন তৈরি করছে—সরকার কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করবে, নাকি দুদক স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ নেবে? নাকি বিষয়টি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবে?
নাগরিক সমাজ ও সুশীল মহল বলছে, একজন সাবেক সচিব প্রকাশ্যে যখন এমন গুরুতর অভিযোগ তোলেন, তখন এটি কেবল কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, সাত্তারের উচিত প্রমাণ সরবরাহ করা, আর দুদকেরও নিজস্ব উদ্যোগে তদন্তে নামা। তাঁর মতে, সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতি নিয়ে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ খুব কমই এসেছে, তাই বিষয়টি শেষ না করে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য একই সুরে বলেছেন—যদি অভিযোগকারী প্রমাণ না দেন, তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের অভিযোগ গুরুত্ব হারাবে, যা দুর্নীতিবিরোধী লড়াইকে দুর্বল করবে।
ঘটনাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি পুরনো অসুখের প্রতিফলন—গুরুতর অভিযোগ উঠে, কিন্তু তা প্রমাণের স্তরে পৌঁছায় না, আবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও যথেষ্ট সক্রিয় হয় না। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমন অভিযোগ কখনো কখনো ক্ষমতা দখল বা চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, কিন্তু জনস্বার্থে স্বচ্ছ তদন্ত প্রক্রিয়া চালানো হয় না। ফলে নাগরিকদের আস্থা কমে, আর দুর্নীতিবাজদের জন্য বার্তা যায়—আইনি জবাবদিহি এড়ানো সম্ভব।
এখন নজর থাকবে তিনটি দিকে—আব্দুস সাত্তার কি তাঁর দাবি করা প্রমাণ প্রকাশ্যে আনবেন? সরকার কি রাজনৈতিক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয় ছাড়াই তদন্তে যাবে? আর দুদক কি সংবিধান ও আইনের ক্ষমতা ব্যবহার করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নেবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্ধারণ করবে, অভিযোগটি রাজনৈতিক নাটক হয়ে মিলিয়ে যাবে, নাকি বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন প্রক্রিয়ায় এটি নতুন একটি উদাহরণ তৈরি করবে।
আপনার মতামত জানানঃ