গবেষণাগারে ‘ব্ল্যাকহোল বোমা’ তৈরির ঘটনা কেবল একটি বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নয়, বরং আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অর্ধশতাব্দী পুরোনো এক তত্ত্বকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করার এক অনন্য সাফল্য। এই সাফল্য আমাদের মহাবিশ্বে শক্তি স্থানান্তরের প্রকৃতি, ঘূর্ণমান জ্যোতিষ্কের আচরণ এবং ব্ল্যাকহোলের রহস্য বোঝার পথে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। ঘটনাটির শেকড় ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে, যখন মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তুগুলোর একটি—ব্ল্যাকহোল—সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা তীব্র কৌতূহলে গবেষণা চালাচ্ছিলেন।
১৯৬৯ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ ও পরবর্তী সময়ে নোবেল বিজয়ী স্যার রজার পেনরোজ একটি বিপ্লবাত্মক ধারণা দেন। তিনি প্রস্তাব করেন, একটি ঘূর্ণমান ব্ল্যাকহোলের ‘এরগোস্ফিয়ার’ নামের অঞ্চলে বিশেষ পরিস্থিতিতে কণিকা বা তরঙ্গ প্রবেশ করালে, সেগুলো অতিরিক্ত শক্তি লাভ করে ব্ল্যাকহোলের ঘূর্ণনশক্তি থেকে শক্তি টেনে আনতে পারে। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘ব্ল্যাকহোল সুপাররেডিয়েন্স’। এটি মূলত শক্তি আহরণের এক কসমিক সংস্করণ—যেন মহাকাশে ভাসমান এক বিশাল ঘূর্ণায়মান ইঞ্জিন থেকে ফ্রি এনার্জি পাওয়া সম্ভব।
এরপর ১৯৭১ সালে বেলারুশের পদার্থবিদ ইয়াকভ জেলদোভিচ এই ধারণাকে আরও বাস্তবসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করতে এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন, কেবল ব্ল্যাকহোল নয়, বরং যে কোনো ঘূর্ণমান পরিবাহী বস্তু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গকে শোষণ না করে বরং তা শক্তিশালী করে প্রতিফলিত করতে পারে। এই ঘটনা—যা ‘জেলদোভিচ ইফেক্ট’ নামে পরিচিত—তত্ত্বগতভাবে প্রমাণ করে যে সুপাররেডিয়েন্স একটি সর্বজনীন প্রক্রিয়া, যা কেবল মহাকাশে নয়, পরীক্ষাগারেও সম্ভব হতে পারে।
এর প্রায় এক বছর পর, ১৯৭২ সালে পদার্থবিদ উইলিয়াম প্রেস এবং সল টেউকোলস্কি আরেক ধাপ এগিয়ে যান। তারা কল্পনা করেন, যদি একটি ঘূর্ণমান ব্ল্যাকহোলের চারপাশে আয়নার মতো প্রতিফলক বসানো হয়, তাহলে ব্ল্যাকহোল থেকে নির্গত তরঙ্গ আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে আবার ব্ল্যাকহোলের দিকে ফিরে আসবে এবং প্রতিবারই আরও শক্তিশালী হবে। এই প্রক্রিয়ায় শক্তি দ্রুত জমা হতে হতে এক সময় ‘ব্ল্যাকহোল বোমা’ তৈরি হবে—যেন একটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরণমুখী সিস্টেম। যদিও তত্ত্বটি চমকপ্রদ ছিল, তখনকার প্রযুক্তি দিয়ে এর সরাসরি পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
পাঁচ দশক পর, অবশেষে সেই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন একদল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী। ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটন, ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগো এবং ইতালির ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের ইনস্টিটিউট ফর ফোটোনিকস অ্যান্ড ন্যানোটেকনোলজির গবেষকেরা মিলিতভাবে তৈরি করলেন এক ল্যাবভিত্তিক ‘ব্ল্যাকহোল বোমা’। ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ তারা তাদের গবেষণাপত্র arXiv প্রিপ্রিন্ট সার্ভারে প্রকাশ করেন, যদিও এটি এখনও পিয়ার-রিভিউ হয়নি।
পরীক্ষায় তারা ব্যবহার করেন একটি অ্যালুমিনিয়ামের সিলিন্ডার, যেটি একটি বৈদ্যুতিক মোটরের সাহায্যে উচ্চ গতিতে ঘোরানো হয়। সিলিন্ডারের চারপাশে বসানো হয় তিন স্তরের ধাতব কুণ্ডলী, যা একদিকে চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে এবং অন্যদিকে আয়নার মতো প্রতিফলন ঘটায়। প্রথম ধাপে তারা একটি দুর্বল চৌম্বক তরঙ্গ সিলিন্ডারের দিকে পাঠান। বিস্ময়করভাবে দেখা যায়, ফেরত আসা তরঙ্গের শক্তি প্রেরিত তরঙ্গের চেয়ে বেশি—এটি ছিল সুপাররেডিয়েন্সের প্রত্যক্ষ প্রমাণ।
পরবর্তী ধাপে তারা প্রাথমিক চৌম্বকক্ষেত্র সরিয়ে ফেলেন। তবুও সার্কিট নিজে থেকে তরঙ্গ তৈরি করতে থাকে, এবং ঘূর্ণমান সিলিন্ডার সেই তরঙ্গকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। ফলাফল—কুণ্ডলীর মধ্যে শক্তি জমা হতে থাকে, ঠিক যেমন প্রেস ও টেউকোলস্কির বর্ণিত ব্ল্যাকহোল বোমা মডেলে ঘটে। কিছু ক্ষেত্রে শক্তি এতটাই বৃদ্ধি পায় যে পরীক্ষামূলক যন্ত্রাংশ বিস্ফোরিত হয়, যা গবেষকদের জন্য একদিকে চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে সাফল্যের প্রমাণ।
এই পরীক্ষার তাৎপর্য গভীর। প্রথমত, এটি প্রমাণ করে যে রোটেশনাল সুপাররেডিয়েন্স ও এক্সপোনেনশিয়াল অ্যামপ্লিফিকেশন শুধু ব্ল্যাকহোলেই সীমাবদ্ধ নয়—এটি পদার্থবিজ্ঞানের একটি সর্বজনীন নীতি। দ্বিতীয়ত, এই মডেল ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাকহোলের ঘূর্ণন, তাপগতিবিদ্যার নিয়ম এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের সংযোগস্থলে থাকা জটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে পারবেন। তৃতীয়ত, ভবিষ্যতে মহাকাশ অনুসন্ধান বা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ শনাক্তকরণ প্রযুক্তিতে এই ধারণার ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখা যেতে পারে।
তবে সীমাবদ্ধতাও আছে। এটি বাস্তব ব্ল্যাকহোল নয়, বরং তার একটি স্কেলড-ডাউন ল্যাব মডেল। প্রকৃত মহাকাশে আয়নার মতো প্রতিফলক কিভাবে তৈরি হবে, বা ঘূর্ণনশক্তি আহরণ প্রযুক্তিগতভাবে কতটা সম্ভব, তা এখনো অনিশ্চিত। তাছাড়া, গবেষণাটি পিয়ার-রিভিউর মাধ্যমে যাচাই না হওয়া পর্যন্ত এর ফলাফল চূড়ান্তভাবে বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে গ্রহণ করা হবে না।
তারপরও, আধা শতাব্দী আগে দেওয়া এক সাহসী তত্ত্বকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ঘটনা বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এটি প্রমাণ করে, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার জগতে যে সব ধারণা প্রথমে অবাস্তব বা কল্পনাপ্রসূত মনে হয়, সঠিক প্রযুক্তি ও ধৈর্যের সমন্বয়ে তা একদিন পরীক্ষাগারে সম্ভব হয়ে ওঠে। ‘ব্ল্যাকহোল বোমা’ এখন আর শুধু কাগজে লেখা কোনো তত্ত্ব নয়—এটি বাস্তবের পরীক্ষাগারে দেখা এক আশ্চর্য ঘটনা, যা মহাবিশ্বের অজানা শক্তির রহস্য উদঘাটনে বিজ্ঞানীদের আরও এক ধাপ এগিয়ে দিল।
আপনার মতামত জানানঃ