একটা সময় ছিল যখন এমন কিছু কল্পনা করাও অসম্ভব মনে হতো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যেন কোনো সায়েন্স ফিকশন সিনেমার দৃশ্য বাস্তবে নেমে এসেছে। চীনের একদল বিজ্ঞানী ঘোষণা করেছেন, তারা তৈরি করেছেন বিশ্বের প্রথম এমন রোবট, যা মানুষের মতো গর্ভধারণ করতে পারে এবং সন্তান জন্ম দিতে পারে। এই রোবটের ভেতরে এমন একটি কৃত্রিম জরায়ু বা আর্টিফিশিয়াল ওম্ব বসানো আছে, যা মানুষের প্রজনন প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি অনুকরণ করে—গর্ভধারণ থেকে শুরু করে শিশুর জন্ম পর্যন্ত।
এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দ্বারা পরিচালিত। পুরো সময়জুড়ে এটি গর্ভের ভেতরের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে এবং নিয়ন্ত্রণ করে। ভ্রূণের বৃদ্ধি, তাপমাত্রা, অক্সিজেন, পুষ্টি—সব কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক রাখে যেন মায়ের গর্ভের মতোই শিশুর বিকাশ হয়। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই প্রাণীর ভ্রূণ এই কৃত্রিম জরায়ুতে সফলভাবে বৃদ্ধি করেছেন, আর এখন তারা মানুষের ভ্রূণ নিয়ে গবেষণা করছেন কঠোর নৈতিক নির্দেশনার অধীনে।
এই প্রযুক্তি শুধু ভবিষ্যতের স্বপ্ন নয়—এটি এখন বাস্তব প্রোটোটাইপ। চীনের গুয়াংজৌ শহরের কাইওয়া টেকনোলজি নামের এক কোম্পানি এটি তৈরি করছে। তাদের দাবি, ২০২৬ সালের মধ্যেই তারা এমন একটি রোবট তৈরি করবে, যার পেটে থাকবে সম্পূর্ণ কৃত্রিম জরায়ু। সেটিতে থাকবে স্বচ্ছ এক চেম্বার, যার ভেতরে তরলে ভাসমান ভ্রূণ বাড়বে, আর এআই সিস্টেম রিয়েল-টাইমে নিয়ন্ত্রণ করবে গর্ভের অবস্থা।
এই উদ্ভাবন মানবজাতির সামনে এক বিশাল প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। এটি কি বন্ধ্যাত্বের সমাধান দিতে পারবে? জটিল গর্ভাবস্থা থেকে নারীদের রক্ষা করবে? অকালপ্রসূত শিশুদের বাঁচাতে সাহায্য করবে? হয়তো পারবে। কিন্তু এর সঙ্গে উঠেছে অনেক বিতর্ক—মাতৃত্ব, নারী-পুরুষের ভূমিকা, এবং মানুষের জন্মের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া কি এখন মেশিনের হাতে চলে যাবে?
অনেকে বলছেন, এটি ভবিষ্যতের নবজাতক চিকিৎসায় বিপ্লব আনতে পারে। আবার কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, হয়তো একদিন স্বাভাবিক গর্ভধারণই বিরল হয়ে পড়বে, আর জন্মের ঘনিষ্ঠ মানবিক অভিজ্ঞতা হারিয়ে যাবে।
কৃত্রিম জরায়ুর ধারণা কিন্তু একেবারে নতুন নয়। ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার এক দল গবেষক ভেড়ার ভ্রূণ একটি কৃত্রিম “বায়োব্যাগ”-এ সফলভাবে বাড়িয়েছিলেন। এটি ছিল এক ধরনের তরলভরা ব্যাগ, যা জরায়ুর পরিবেশ নকল করত। সেখান থেকেই শুরু হয় “এক্টোজেনেসিস” বা শরীরের বাইরে সন্তান ধারণের ধারণা। কিন্তু চীনের এই রোবট বিষয়টিকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে—এটি কেবল ভ্রূণ রক্ষা নয়, পুরো গর্ভকালীন সময় এবং সন্তান জন্মের প্রক্রিয়াকেও মেশিনের হাতে তুলে দিচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই রোবটের ভেতরে এআই তাপমাত্রা, অক্সিজেন ও পুষ্টির মাত্রা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঠিক রাখবে। কৃত্রিম তরল দিয়ে ভেতরের পরিবেশ তৈরি করা হবে মায়ের গর্ভের মতো। শিশুটি একটি সিন্থেটিক “নাভিরজ্জু”-এর মাধ্যমে পুষ্টি পাবে। তারা দাবি করছে, এর বেশ কিছু অংশ ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে এবং এখন বাকি কাজ হলো এটি রোবট শরীরে সংযোজন করা। এমনকি, একজন মানুষ ও রোবটের যৌথ প্রক্রিয়ায় গর্ভধারণ সম্ভব হবে বলেও তাদের দাবি।
এই রোবটের সম্ভাব্য দাম হতে পারে প্রায় এক লাখ ইউয়ান, অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। এটি অনেক দেশের সারোগেসির তুলনায় অনেক সস্তা।
এই প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকও অনেক। প্রথমত, এটি বন্ধ্যাত্বে ভোগা দম্পতিদের জন্য এক নতুন আশা দিতে পারে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ দম্পতি সন্তান ধারণে অক্ষম। দ্বিতীয়ত, অনেক নারীর জন্য গর্ভাবস্থা শারীরিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ—রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বা অন্যান্য জটিলতার কারণে মা ও শিশুর প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। কৃত্রিম গর্ভ সেই ঝুঁকি দূর করতে পারে। তৃতীয়ত, গবেষণার দিক থেকেও এটি বড় সুযোগ এনে দিতে পারে। বিজ্ঞানীরা গর্ভের ভেতর শিশুর বিকাশ আরও বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন, জন্মগত ত্রুটি আগেই চিহ্নিত করতে পারবেন।
তবে এই প্রযুক্তির ঝুঁকিও কম নয়। মানুষের গর্ভের মতো পরিবেশ তৈরি করা বিজ্ঞানীদের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। গর্ভাবস্থা কেবল পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহ নয়—এর সঙ্গে জড়িত মায়ের হরমোন, ইমিউন সিস্টেম, কোষীয় সংকেত, এমনকি মায়ের মাইক্রোবায়োম পর্যন্ত। এসব কিছু এখনো পুরোপুরি বোঝা যায়নি। ফলে পুরো মানব গর্ভকাল মেশিনে পুনরায় তৈরি করা এখনো অসম্ভবের কাছাকাছি।
নৈতিক দিক থেকেও প্রশ্ন আছে। একটি শিশুর জন্ম যদি পুরোপুরি মেশিনের মাধ্যমে হয়, তাহলে মাতৃত্বের ভূমিকা কোথায় থাকবে? মা-সন্তানের বন্ধন কি হারিয়ে যাবে? এছাড়া জন্ম নেয়া শিশুর আইনি ও সামাজিক পরিচয় কী হবে? পিতৃত্ব-মাতৃত্ব, উত্তরাধিকার, এমনকি মানবাধিকারের প্রশ্নও উঠে আসছে।
চীনের প্রেক্ষাপটে এই উদ্ভাবনের পেছনে আরেকটি কারণ আছে—তাদের জন্মহার ভয়ংকরভাবে কমে গেছে। বর্তমানে চীনে বন্ধ্যাত্বের হার প্রায় ১৮ শতাংশ, যা আগের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে সরকারও জন্মহার বাড়াতে নতুন প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী। কোম্পানিটি স্থানীয় সরকারের কাছে ইতিমধ্যে আইনগত অনুমতির জন্য আবেদন করেছে।
কিন্তু এর সব দিক সমান নয়। একদিকে চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, এটি অকালপ্রসূত শিশুদের বাঁচাতে নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি মানুষের সম্পর্ক ও সমাজব্যবস্থায় বিশাল পরিবর্তন আনবে। যদি গর্ভধারণ পুরোপুরি শরীরের বাইরে সম্ভব হয়, তাহলে নারী-পুরুষের ভূমিকা কীভাবে বদলাবে? মাতৃত্ব তখন কী অর্থ বহন করবে? সন্তান জন্ম কি তখন ভালোবাসা থেকে বেশি প্রযুক্তির ফল হয়ে উঠবে?
অর্থনৈতিকভাবেও এটি বড় বৈষম্য তৈরি করতে পারে। ধনী পরিবার হয়তো সহজেই রোবট ব্যবহার করতে পারবে, কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নাও হতে পারে। ফলে “মেশিনে জন্ম” এক শ্রেণি বিশেষের বিশেষাধিকার হয়ে উঠতে পারে।
মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নিয়েও উদ্বেগ আছে। শিশুটি গর্ভে যে অভিজ্ঞতা পায়—মায়ের হৃদস্পন্দন, কণ্ঠস্বর, অনুভূতি—সবই তার মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলে। যদি এসব না থাকে, তাহলে শিশুর আবেগীয় বিকাশ কীভাবে ঘটবে? কেউ কেউ মনে করেন, এটি ভবিষ্যতে মানুষকে আরও একা ও যান্ত্রিক করে তুলবে।
আইনগত দিকেও অজস্র প্রশ্ন। একটি কৃত্রিম গর্ভে জন্ম নেয়া শিশুর নাগরিক পরিচয় কী হবে? কে হবে তার আইনি অভিভাবক? ধর্মীয়ভাবে তার অবস্থান কী? এসব বিষয়ে কোনো দেশেরই এখনো স্পষ্ট আইন নেই।
তবু মানব ইতিহাসে প্রযুক্তি সব সময়ই এগিয়েছে, বিতর্ক সত্ত্বেও। কেউ হয়তো মনে করবে এটি অমানবিক, কেউ বলবে এটি মুক্তি। হয়তো শুরুতে কেবল চিকিৎসা প্রয়োজনে এটি ব্যবহৃত হবে—ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা বা অকালপ্রসূত শিশুর জন্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, প্রযুক্তি উন্নত হলে, হয়তো এটি সাধারণ ব্যবহারে চলে আসবে। তখন সমাজকে নতুন করে ভাবতে হবে, মানুষ হওয়া মানে কী।
চীনের এই রোবট প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্বজুড়ে এখনই বিতর্ক শুরু হয়েছে। কেউ একে ভবিষ্যতের বিপ্লব বলছে, কেউ আবার মানবতার বিপদ। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট—কৃত্রিম গর্ভ এখন আর কল্পনা নয়, এটি বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে।
এই প্রযুক্তি হয়তো কখনো নারীদের জায়গা নিতে পারবে না, কিন্তু এটি নিশ্চয়ই পরিবর্তন করে দেবে আমাদের মাতৃত্ব, জন্ম, এবং জীবনের অর্থ সম্পর্কে ধারণা। এটি এক নতুন যুগের সূচনা—যেখানে জীবন শুরু হবে মায়ের শরীরে নয়, বরং মেশিনের ভেতর।
আপনার মতামত জানানঃ