পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাণীর উদ্ভব নিয়ে বহু বিতর্ক চলেছে। কোন প্রাণী প্রথম ছিল তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা শতাব্দী ধরে গবেষণা করছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) বিজ্ঞানীরা একটি চমকপ্রদ আবিষ্কার করেছেন। তারা জানিয়েছেন, পৃথিবীর প্রথম প্রাণী সম্ভবত প্রাচীন সামুদ্রিক স্পঞ্জ ছিল। এটি প্রায় ৫ কোটি ৪১ লাখ বছরেরও বেশি পুরনো শিলায় পাওয়া রাসায়নিক জীবাশ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা গেছে। এই আবিষ্কার আমাদের পূর্বের ধারণা পরিবর্তন করেছে, কারণ আগে ধারণা করা হতো ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণের সময় পৃথিবীতে জটিল প্রাণীর উদ্ভব ঘটে। কিন্তু স্পঞ্জের এই প্রাচীন জীবাশ্ম প্রমাণ করছে, ক্যামব্রিয়ান যুগের অনেক আগে থেকেই নরম-দেহী, সামুদ্রিক প্রাণী পৃথিবীতে উপস্থিত ছিল।
গবেষকরা বলছেন, তারা ওমান, পশ্চিম ভারত এবং সাইবেরিয়ার শিলার নমুনা পরীক্ষা করেছেন। এ সময় তারা “স্টেরেনস” নামক একটি বিরল রাসায়নিক বায়োমার্কার খুঁজে বের করেন। স্টেরেনস হলো স্টেরলের স্থিতিশীল রাসায়নিক অবশেষ, যা জটিল জীবের কোষ পর্দার অপরিহার্য উপাদান। বিশেষভাবে এই স্টেরেনসের সি৩০ ও সি৩১ সংস্করণ কেবল ডেমোস্পঞ্জ থেকে তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ, এই রাসায়নিকের উপস্থিতি প্রমাণ করছে যে পৃথিবীর প্রথম প্রাণী স্পঞ্জের পূর্বপুরুষই ছিল।
স্পঞ্জকে সাধারণত খুবই সাধারণ প্রাণী হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এর গুরুত্ব অপরিসীম। সমুদ্রের পানি ছেঁকে খাদ্য সংগ্রহের মাধ্যমে এই প্রাণীরা প্রাথমিকভাবে মহাসাগরে অক্সিজেন সরবরাহ করেছিল। এইভাবে প্রাথমিক জীবনের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। বিজ্ঞানী রজার সামন্স এই আবিষ্কারকে সমর্থন করে বলেন, তাদের কাছে তিনটি স্বাধীন এবং পারস্পরিক সম্মত প্রমাণ আছে, যা স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে স্পঞ্জই প্রথম প্রাণী।
স্পঞ্জের প্রাচীন জীবাশ্ম থেকে জানা যায়, এই প্রাণী জটিল জীবনধারার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। স্পঞ্জের দেহ নরম এবং ছিদ্রযুক্ত, যা তাদের সমুদ্রের পানি ছেঁকে খাবার সংগ্রহ করতে সাহায্য করত। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা পানির মাধ্যমে পুষ্টি গ্রহণ করত এবং অক্সিজেন উৎপাদনে অবদান রেখেছিল। এই দিক দিয়ে বলা যায়, প্রাচীন স্পঞ্জ শুধুমাত্র প্রথম প্রাণীই নয়, বরং পৃথিবীতে জীবনধারাকে সমর্থন করার প্রথম ইকোসিস্টেম নির্মাতার ভূমিকা পালন করেছিল।
গবেষকরা এই আবিষ্কারকে আরও শক্তিশালী করতে বলছেন, এটি কেবল এক জায়গার শিলা থেকে প্রমাণ নয়। ওমান, পশ্চিম ভারত এবং সাইবেরিয়ার শিলায় মিলিয়ে এই জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে প্রাচীন সামুদ্রিক স্পঞ্জ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিল। তাদের জীবাশ্মের রাসায়নিক বিশ্লেষণ দেখাচ্ছে যে, এই প্রাণীরা প্রায় ৫ কোটি ৪১ লাখ বছরেরও বেশি পুরনো। এটি এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন প্রাণীর পরিচয় দিতে সক্ষম।
এছাড়াও বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, প্রাচীন স্পঞ্জের উদ্ভব আমাদেরকে জীবনের শুরু এবং জটিল জীবনের উদ্ভব সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। আগে ধারণা করা হতো, ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণের সময় হঠাৎ করেই জটিল প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু স্পঞ্জের এই জীবাশ্ম প্রমাণ করছে, নরম-দেহী প্রাণী বহু বছর আগে থেকে পৃথিবীতে বিদ্যমান ছিল। অর্থাৎ জটিল জীবনের সূচনা অনেক আগেই শুরু হয়েছিল।
স্পঞ্জের দেহের গঠনও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের দেহে যেসব ছিদ্র থাকে, তা পানির মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণে সাহায্য করে। এছাড়াও তারা পানি চলাচলের মাধ্যমে আংশিকভাবে অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে। অর্থাৎ, প্রাথমিকভাবে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য বজায় রাখতে স্পঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এছাড়া তাদের উপস্থিতি সমুদ্রের মাইক্রোবাস্তুসংস্থান বা মাইক্রোইকোসিস্টেমের ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করত।
বিজ্ঞানীরা আরও বলেন, এই আবিষ্কার শুধুমাত্র জীবাশ্মের উপর ভিত্তি করে নয়, রাসায়নিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। স্টেরেনসের উপস্থিতি নিশ্চিত করছে যে, এই প্রাণী কেবল নরম-দেহীই নয়, তার কোষ গঠনও জটিল জীবের অনুরূপ ছিল। এটি প্রমাণ করছে যে, জীবনের বিবর্তন দীর্ঘমেয়াদী এবং ধাপে ধাপে ঘটেছে।
এই আবিষ্কার থেকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাচীন স্পঞ্জ সমুদ্রের তলদেশে বাস করত। তাদের খাদ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া এবং পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় দীর্ঘমেয়াদি বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করেছিল। এটি নির্দেশ করছে, পৃথিবীর প্রথম প্রাণী কেবল জীবনধারণেই দক্ষ ছিল না, বরং পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনেও সক্ষম ছিল।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই আবিষ্কার ভবিষ্যতে প্রাণীর বিবর্তন নিয়ে গবেষণায় নতুন দিক নির্দেশ করতে পারে। এটি দেখাচ্ছে, জীবনের শুরু খুবই সরল এবং সাধারণ প্রাণীর মাধ্যমে হলেও পৃথিবীতে জটিল জীবন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে গবেষকরা বুঝতে পারছেন, প্রাথমিক জীবনের সময় সূক্ষ্ম ও সরল প্রাণীর ভূমিকা কেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
মোটের উপর, এমআইটি বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার পৃথিবীতে জীবনের উদ্ভব এবং প্রাথমিক প্রাণীকে নিয়ে আমাদের জ্ঞানকে পরিবর্তন করেছে। প্রাচীন সামুদ্রিক স্পঞ্জ পৃথিবীর প্রথম প্রাণী হিসেবে পরিচিত হওয়ায় এটি প্রমাণ করে যে, জীবনের শুরু নরম-দেহী, সরল প্রাণীর মাধ্যমে হলেও সমুদ্রের পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। এই আবিষ্কার আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য কেবল জটিল প্রাণী দিয়ে নয়, বরং প্রাথমিক প্রাণী ও তাদের পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ