পৃথিবীর সব জীবনের উৎস কি একটিই? ব্যাকটেরিয়া থেকে মানুষ, শৈবাল থেকে নীল তিমি— এত বৈচিত্র্যময় প্রাণের ভিড়ে এই প্রশ্ন বহু দিন ধরেই বিজ্ঞানীদের ভাবিয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণা সেই পুরনো প্রশ্নকেই নতুন করে সামনে এনে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, জীবনের সূচনাকালকে বিজ্ঞানীরা আরও অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছেন। এত দিন মনে করা হচ্ছিল, পৃথিবী সৃষ্টির প্রায় ৬০ কোটি বছর পরে প্রথম জীবের আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু নতুন গবেষণার দাবি, সেই আদিম পূর্বসূরি আরও ২০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে উপস্থিত ছিল।
আজ থেকে প্রায় ৪৬০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর জন্ম। জন্মের পরের কয়েকশো মিলিয়ন বছর ছিল ভয়ঙ্কর উত্তাল। উল্কাপাত, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, বিষাক্ত গ্যাসে ভরা বায়ুমণ্ডল— আজকের পৃথিবীর সঙ্গে সেই সময়ের কোনও মিলই ছিল না। তবু সেই প্রতিকূল পরিবেশেই ধীরে ধীরে জীবনের বীজ অঙ্কুরিত হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবী গঠনের প্রায় ৪০ কোটি বছরের মধ্যেই প্রথম জীবনের আবির্ভাব ঘটে। এই ধারণা জীবনের ইতিহাস নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনাকেই আমূল বদলে দিচ্ছে।
বিবর্তনের দীর্ঘ ইতিহাসে এক কেন্দ্রীয় ধারণা হল ‘লাস্ট ইউনিভার্সাল কমন অ্যানসেস্টর’, সংক্ষেপে লুকা। লুকা কোনও নির্দিষ্ট প্রজাতি নয়, বরং এমন এক আদিম জীব, যার মধ্যেই বর্তমান পৃথিবীর সমস্ত জীবের পূর্বসূরির বৈশিষ্ট্য নিহিত ছিল। মানুষ যেমন আদিম বানরজাতীয় পূর্বসূরি থেকে এসেছে, তেমনই সব স্তন্যপায়ী প্রাণী, সব মেরুদণ্ডী প্রাণী এবং শেষ পর্যন্ত সমস্ত জীবই এক জায়গায় এসে মিলেছে এই লুকা নামের বিন্দুতে। বিবর্তনের বংশলতিকা কল্পনা করলে দেখা যায়, অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নীচের দিকে নেমে গিয়ে একটিমাত্র কাণ্ডে মিলেছে— সেটিই লুকা।
বহু দিন ধরেই বিজ্ঞানীরা অনুমান করছিলেন, লুকার আবির্ভাব ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে। অর্থাৎ পৃথিবী সৃষ্টির প্রায় ৬০ কোটি বছর পরে। কিন্তু ব্রিটেনের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নেতৃত্বে সাম্প্রতিক এক গবেষণা সেই সময়সীমাকে আরও পিছিয়ে নিয়ে গেছে। তাঁদের দাবি, লুকার আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ৪২০ কোটি বছর আগে। এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন’ জার্নালে। গবেষণার পদ্ধতিও ছিল অত্যন্ত আধুনিক ও জটিল।
এত প্রাচীন সময়ের জীবের কোনও প্রত্যক্ষ জীবাশ্ম আজও পাওয়া যায়নি। কারণ পৃথিবীর সেই সময়কার পাথর খুব কমই আজ পর্যন্ত অপরিবর্তিত অবস্থায় টিকে আছে। ফলে সরাসরি প্রমাণের পথ প্রায় বন্ধ। কিন্তু বিজ্ঞানীরা আশ্রয় নিয়েছেন আণুবীক্ষণিক ফাইলোজেনেটিক্সের। বর্তমান পৃথিবীতে জীবিত বিভিন্ন প্রাণীর জিন বিশ্লেষণ করে তাঁরা বোঝার চেষ্টা করেছেন, কোন কোন বৈশিষ্ট্য সব জীবের মধ্যেই সাধারণ। সেই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলির সূত্র ধরেই লুকার সময়কাল এবং প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা হয়েছে।
এই বিশ্লেষণ থেকে উঠে এসেছে চমকপ্রদ কিছু তথ্য। বিজ্ঞানীদের মতে, লুকা ছিল একটি সরল প্রোক্যারিওট, অর্থাৎ এককোষী অণুজীব। তার মধ্যে আধুনিক কোষের মতো নিউক্লিয়াস ছিল না। তবু এটি নিছক একেবারে আদিম ও অগোছালো কোনও জীব ছিল না। বরং তার মধ্যেই ছিল জটিল জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ছাপ। গবেষণায় ইঙ্গিত মিলেছে, এই অণুজীবের মধ্যে কোনও না কোনও ধরনের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও থাকতে পারে। অর্থাৎ জীবনের খুব প্রাথমিক পর্যায়েই আত্মরক্ষার কৌশল গড়ে উঠতে শুরু করেছিল।
লুকা একা একা পৃথিবীতে বাস করত— এমন ধারণাও ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের অনুমান, সেই আদিম পৃথিবীতে লুকার মতো আরও কিছু অণুজীব হয়তো সহাবস্থান করত। একে অপরের বর্জ্য ব্যবহার করে তারা টিকে থাকত। এই পারস্পরিক নির্ভরতার মাধ্যমেই সম্ভবত এক ধরনের প্রাথমিক বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছিল। আজকের জটিল খাদ্যশৃঙ্খলের বীজ হয়তো সেখানেই নিহিত ছিল। যদিও এই বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন।
জীবনের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ। আজ থেকে প্রায় ৫৩ থেকে ৫৪ কোটি বছর আগে এই সময়কালে পৃথিবীতে হঠাৎ করেই বিপুল বৈচিত্র্যের প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে। মেরুদণ্ডী প্রাণীরাও প্রথম এই সময়েই দেখা দেয়। তার আগে জীবনের বিস্তার ছিল তুলনামূলক ধীর। ক্যামব্রিয়ান যুগে যেন আচমকাই বিবর্তনের গতি বেড়ে যায়। কিন্তু এই বিস্ফোরণের অনেক আগেই যে জীবনের ভিত্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল, নতুন গবেষণা সেই দিকেই আঙুল তুলছে।
যদি লুকার আবির্ভাব সত্যিই ৪২০ কোটি বছর আগে হয়ে থাকে, তবে তার মানে পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জীবন জন্ম নিয়েছিল। এর তাৎপর্য বিশাল। এর অর্থ, অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হলেই জীবন গড়ে ওঠা খুব কঠিন নয়। এই ধারণা মহাকাশে প্রাণের সন্ধানকেও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। অন্য গ্রহে যদি পৃথিবীর মতো পরিবেশ কোনও সময়ের জন্যও তৈরি হয়ে থাকে, তবে সেখানে আদিম জীবনের জন্ম হওয়াটা অসম্ভব নয়।
তবে এখনও বহু প্রশ্নের উত্তর অজানা। লুকা ঠিক কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল, কোন পরিবেশে তার জন্ম, কী ছিল তার শক্তির উৎস— এই সব প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর এখনও বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। তবু আধুনিক প্রযুক্তি ও জিনগত বিশ্লেষণের সাহায্যে ধীরে ধীরে সেই অতীতের পর্দা একটু একটু করে সরছে। প্রত্যক্ষ জীবাশ্ম না থাকলেও, জীবনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা জিনগত স্মৃতি বিজ্ঞানীদের পথ দেখাচ্ছে।
এই গবেষণা শুধু অতীত জানার চেষ্টা নয়, ভবিষ্যতের দিকেও ইঙ্গিত বহন করে। মানুষ আজ এমন এক সময় দাঁড়িয়ে আছে, যখন প্রযুক্তির মাধ্যমে জীবনের মৌলিক গঠন নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। জীবনের উৎস সম্পর্কে গভীর বোঝাপড়া আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কেও নতুন করে ভাবতে শেখায়। আমরা যে পৃথিবীর ইতিহাসের এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, সেই বোধ আরও স্পষ্ট হয়।
সবশেষে বলা যায়, লুকার আবির্ভাবের সময়সীমা আরও পিছিয়ে যাওয়ার এই দাবি আমাদের চেনা ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে বাধ্য করছে। পৃথিবীর সব জীবনের মূল যদি সত্যিই এতটা প্রাচীন হয়, তবে জীবন শুধু একটি দৈব ঘটনা নয়, বরং প্রকৃতির এক গভীরভাবে প্রোথিত সম্ভাবনা। সেই উপলব্ধি মানুষকে যেমন বিনয়ী করে, তেমনই কৌতূহলীও করে তোলে— এই বিশাল মহাবিশ্বে আমরা আদৌ একা তো নই?
আপনার মতামত জানানঃ