ঢাকার কারওয়ানবাজারে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতটা ছিল আগুন, ধোঁয়া আর আতঙ্কে মোড়া। গভীর রাতে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই মুহূর্তের মধ্যে সেই শোক ও ক্ষোভ রূপ নেয় সহিংসতায়। একদল হামলাকারী দেশের দুই শীর্ষ সংবাদমাধ্যম—দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের অফিসে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সংবাদকর্মীরা তখন অফিসের ভেতর আটকে পড়েন, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে কালো ধোঁয়া, আগুনের লেলিহান শিখা আর ভাঙচুরের শব্দ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ক্রেনের সাহায্যে ঝুঁকি নিয়ে তাদের উদ্ধার করেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে কেবল দুটি ভবনই নয়, আক্রান্ত হয় দেশের গণমাধ্যম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক নিরাপত্তার অনুভূতি।
শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে যে দৃশ্য দেখা যায়, তা ছিল ধ্বংসের নিঃশব্দ সাক্ষ্য। প্রথম আলোর চারতলা ভবনটি প্রায় পুরোপুরি পুড়ে গেছে, কোথাও কোথাও তখনও ধোঁয়া উঠছিল। ভবনের ভেতরের বিভিন্ন বিভাগ, যেখান থেকে প্রতিদিন খবর তৈরি হয়ে পাঠকের হাতে পৌঁছাত, সেগুলো এখন ছাই আর পোড়া ধ্বংসস্তূপ। ডেইলি স্টারের ভবনেও একই চিত্র—নিচতলা ও দোতলা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত, ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে ভাঙা আসবাব, ছাই হয়ে যাওয়া কাগজপত্র, পুড়ে যাওয়া যন্ত্রপাতি। বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি থাকলেও ভেতরের ক্ষত যেন সহজে ভরাট হওয়ার নয়।
এই হামলার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে সংবাদকর্মীদের জীবনে ও কাজে। প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থাসহ বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় অনলাইন পোর্টালের কাজও সাময়িকভাবে স্থগিত রাখতে হয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিরাপত্তাজনিত কারণে পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে তারা। ডেইলি স্টারের কয়েকজন কর্মী জানান, হামলাকারীরা ভবনের প্রায় প্রতিটি তলায় ভাঙচুর চালিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করেছে। একজন সংবাদকর্মী আবেগভরা কণ্ঠে বলেন, তার ক্যামেরা, রেকর্ডিং ডিভাইস, হার্ডড্রাইভ—সবকিছু নিয়ে গেছে হামলাকারীরা, যেখানে সংরক্ষিত ছিল তার সারা জীবনের কাজ ও স্মৃতি। ভয় ও আতঙ্ক কাটিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথা বলার মতো মানসিক অবস্থায় নেই অনেকেই।
কিন্তু এই সহিংসতা কেবল রাজধানীর দুটি মিডিয়া অফিসেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাতভর দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ধানমন্ডিতে বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের ভবনে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়ে আগুন লাগানো হয়। পরে সংগঠনের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তনের ক্লাসসহ সব কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। ধানমন্ডি-৩২–এ অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির অবশিষ্ট অংশেও আবার আগুন দেওয়া হয়, ভেঙে ফেলা হয় দেয়াল। সকালে টেলিভিশনের লাইভ ফুটেজে দেখা যায়, কয়েকজন ইট দিয়ে বাড়ির অবশিষ্ট অংশ ভাঙছে—যেন ধ্বংসের মধ্যেও ধ্বংসের পুনরাবৃত্তি।

রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রামেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর কিছু লোক ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়লে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়, পরে রাতের দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। একই রাতে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়রের বাসায় আগুন দেওয়া হয়, রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, একটি মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে কত দ্রুত সহিংসতা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং কত সহজে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এই সহিংসতার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় প্রতিক্রিয়ার পালা। ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেইজ থেকে দেওয়া এক বার্তায় বলা হয়, ওসমান হাদীকে যারা হত্যা করেছে, তাদের হাতে দেশকে তুলে না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সেখানে ভাঙচুর ও অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলা হয় এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর পতিত স্বৈরাচারী শাসনের সুযোগ নিয়ে দুস্কৃতিকারীরা আবারো দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। তিনি হামলাকারীদের কঠোর হাতে দমন করার আহ্বান জানান। জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান পরিস্থিতিতে ধৈর্য ও প্রজ্ঞার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ধৈর্যই মজলুমের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার এবং দেশ সবার অস্তিত্বের অংশ।
এই বক্তব্যগুলো একদিকে যেমন রাজনৈতিক অবস্থানকে তুলে ধরে, অন্যদিকে তেমনি প্রশ্ন তোলে—এই সহিংসতার দায় কার, এবং এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। একটি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রতিশোধের ভাষা যখন আগুন আর ভাঙচুরে রূপ নেয়, তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিরপরাধ মানুষ, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো। সংবাদমাধ্যমে হামলা মানে কেবল ইট-পাথরের ওপর আঘাত নয়, এটি তথ্যপ্রবাহ, জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক চর্চার ওপর আঘাত।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সামনে শুক্রবার সকালে মানুষ জড়ো হতে দেখা গেছে। কেউ নীরবে দাঁড়িয়ে ক্ষয়ক্ষতির দিকে তাকাচ্ছেন, কেউ মোবাইলে ছবি তুলছেন, কেউ আবার ক্ষোভ আর হতাশার কথা বলছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি থাকলেও সাধারণ মানুষের চোখে প্রশ্ন—এই সহিংসতা কি রোধ করা যেত না? কেন সময়মতো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? পুলিশের সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পর্যাপ্ত তথ্য না পাওয়ার ঘটনা এই প্রশ্নগুলোকে আরও জোরালো করে।
এই রাতের ঘটনাগুলো বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার এক নগ্ন প্রতিচ্ছবি। এখানে শোক আছে, ক্ষোভ আছে, কিন্তু তার সঙ্গে আছে অসহিষ্ণুতা, প্রতিহিংসা আর আইনের শাসনের দুর্বল প্রয়োগ। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ঐতিহাসিক স্থাপনা ও সংবাদমাধ্যম—সবাই যেন একই সহিংস স্রোতের মধ্যে ভেসে যাচ্ছে। যে সমাজে মতভিন্নতার জবাব আগুন দিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে নিরাপত্তা ও সহাবস্থানের ধারণা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ে।
এই সহিংসতার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কেবল ক্ষতিগ্রস্ত ভবন মেরামতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি সংবাদকর্মীদের মানসিক নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক চর্চার স্বাধীনতা ও সাধারণ মানুষের আস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। একটি দেশের গণমাধ্যম যখন আক্রমণের শিকার হয়, তখন তা আন্তর্জাতিক পরিসরেও বার্তা দেয়—এই সমাজ কতটা সহনশীল, কতটা নিরাপদ। একইভাবে সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ঐতিহাসিক স্থাপনায় হামলা জাতির স্মৃতি ও পরিচয়ের ওপর আঘাত করে।
ওসমান হাদির মৃত্যু একটি গুরুতর ঘটনা, যার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রয়োজন। কিন্তু সেই দাবির আড়ালে যদি সহিংসতা, ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগকে বৈধতা দেওয়া হয়, তবে ন্যায়বিচারের পথ আরও জটিল হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখানে স্পষ্ট—আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। একই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব আরও বড়—উত্তেজনা প্রশমিত করা, সহিংসতার ভাষা পরিহার করা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ বার্তা দেওয়া।
কারওয়ানবাজারের পোড়া ভবনগুলো কেবল একটি রাতের সহিংসতার সাক্ষ্য নয়, এগুলো আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতার প্রতীকও। এই ছাইয়ের স্তূপের ভেতর থেকে যদি শিক্ষা না নেওয়া যায়, যদি সহনশীলতা ও আইনের পথে ফেরার সংকল্প না জাগে, তবে ভবিষ্যতেও এমন রাত ফিরে আসতে পারে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি সেই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত, নাকি এই ধ্বংসস্তূপের মাঝেই নতুন করে শান্তি, দায়িত্ববোধ ও গণতান্ত্রিক চর্চার পথ খুঁজে নেব।
আপনার মতামত জানানঃ