লালমনিরহাটে সম্ভাব্য বিমানঘাঁটি নিয়ে ভারতীয় রাজনীতি, চীনের উপস্থিতি, এবং বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান—এই পুরো বিষয়টি শুধু একটি সামরিক অবকাঠামো নির্মাণের গল্প নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির এক জটিল চিত্র। ভারতের ‘চিকেন নেক’ বা শিলিগুড়ি করিডোরের একেবারে কাছাকাছি লালমনিরহাট, যা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের একমাত্র সরু সংযোগ পথ। এখানে চীনা অর্থায়নে বিমানঘাঁটি বা এয়ারফিল্ড পুনরায় সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কীর্তিবর্ধন সিং সম্প্রতি লোকসভায় জানিয়েছেন, তারা এই প্রকল্প সম্পর্কিত সব ধরনের প্রতিবেদন নজরে রেখেছেন এবং জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টর গত মে মাসে যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তা ভারত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। সেখানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ নাজিম-উদ-দৌলা স্পষ্ট করে বলেন, বর্তমানে এই এয়ারফিল্ড সামরিক কাজে ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা নেই। তবু ভারতের আশঙ্কা কমছে না, কারণ ভূরাজনীতিতে ‘সম্ভাবনা’ এবং ‘উদ্দেশ্য’—দুটোই গুরুত্ব পায়, এবং অবস্থানগত কারণে এই স্থানের কৌশলগত মূল্য অপরিসীম।
চিকেন নেকের ভৌগোলিক বাস্তবতা বোঝা জরুরি। এটি মাত্র ২২ কিলোমিটার চওড়া একটি করিডোর, যার মাধ্যমে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। এখানে যেকোনো বিদেশি প্রভাব বা সামরিক উপস্থিতি ভারতের জন্য নিরাপত্তাজনিত বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বিরোধ, বিশেষ করে ডোকলাম ও লাদাখে সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে, ভারতের নীতি নির্ধারকরা লালমনিরহাটে কোনো চীনা-সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোকে সন্দেহের চোখে দেখবেন—এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বলছে, এই বিমানঘাঁটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই ছিল, যা পরে পাকিস্তান ও স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ব্যবহার করেছে। বহু বছর নিষ্ক্রিয় থাকার পর এটি পুনরায় চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা সরকারি ভাষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের অংশ। সেনাবাহিনী আরও বলেছে, চীনের ব্যবহার প্রসঙ্গে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই এবং সরকার ‘ভেবেচিন্তেই’ সিদ্ধান্ত নেবে। তবে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ‘অস্বীকার’ বা ‘নেই’ কথাগুলো সবসময় সরল অর্থে নেওয়া যায় না, বিশেষত যখন প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
২০১৯ সালে শেখ হাসিনার আমলে এই জায়গাটি বাংলাদেশ অ্যারোস্পেস অ্যান্ড অ্যাভিয়েশন ইউনিভার্সিটিকে দেওয়া হয়েছিল। চীন গত এক দশকে বাংলাদেশে অবকাঠামো ও প্রতিরক্ষা খাতে বড় বিনিয়োগকারী হয়ে উঠেছে—পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা বন্দর, এমনকি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ—সবখানেই চীনের উপস্থিতি স্পষ্ট। ফলে লালমনিরহাট প্রকল্পকেও ভারত সেই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে দেখছে।
আঞ্চলিক রাজনীতিতে এই পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে চীন-ভারত প্রতিযোগিতা। চীন বাংলাদেশের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চায়, যা ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ নীতির অংশ হতে পারে। অন্যদিকে ভারত দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের নিরাপত্তা বলয় বজায় রাখতে চায় এবং বাংলাদেশকে কৌশলগত মিত্র হিসেবে ধরে রাখতে চায়। বাংলাদেশের জন্য এই অবস্থান কূটনৈতিকভাবে সংবেদনশীল—একদিকে চীনের বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা, অন্যদিকে ভারতের ভৌগোলিক নৈকট্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতা।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—বাংলাদেশ কি কেবল অবকাঠামো উন্নয়ন করছে, নাকি ভবিষ্যতে এটি সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে? সামরিক ইতিহাসে দেখা যায়, একটি বিমানঘাঁটি একবার সম্পূর্ণ সক্রিয় হলে তার ব্যবহারের ধরণ বদলাতে খুব বেশি সময় লাগে না। প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণ, জরুরি অবতরণ বা বেসামরিক ব্যবহারের জন্য চালু করা হলেও, প্রয়োজনে সেটি দ্রুত সামরিক মিশনে রূপান্তরিত হতে পারে।
চীনের এই প্রকল্পে সংশ্লিষ্টতা ভারতের কাছে কেবল সীমান্ত নিরাপত্তা নয়, বরং গোয়েন্দা কার্যক্রম, নজরদারি এবং সম্ভাব্য লজিস্টিক সুবিধার আশঙ্কা তৈরি করছে। লালমনিরহাট থেকে উত্তরবঙ্গ, আসাম, সিকিম ও ভুটান পর্যন্ত আকাশপথে নজরদারি সম্ভব। এমনকি স্যাটেলাইট ডেটা সংগ্রহ ও সামরিক যোগাযোগে এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের জন্যও এখানে কিছু কৌশলগত হিসাব রয়েছে। চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাংলাদেশকে আধুনিক প্রযুক্তি, কম খরচে সামরিক সরঞ্জাম এবং অবকাঠামো উন্নয়নের সুযোগ দিচ্ছে। কিন্তু ভারতের আস্থার সংকট বাড়ানো বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে। ইতিমধ্যেই তিস্তা নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার মতো বিষয়গুলোতে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন আছে। লালমনিরহাট ইস্যু সেই টানাপোড়েন আরও বাড়াতে পারে।
অন্যদিকে চীন এই ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের উপস্থিতি মজবুত করছে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটার বন্দর, পাকিস্তানের গওয়াদার বন্দর, মিয়ানমারের কিয়াকপিউ—সবখানেই চীনের বিনিয়োগ আছে, যা অনেক ক্ষেত্রে পরে সামরিক বা কৌশলগত ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করেছে। ভারত ভয় পাচ্ছে, লালমনিরহাটও সেই তালিকায় যোগ হতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি শুধু একটি অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয় নয়, বরং এটি ভারত-চীন-বাংলাদেশের ত্রিমুখী ভূরাজনীতির নতুন এক অঙ্ক। বাংলাদেশ যদি দক্ষতার সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে, তবে এটি অর্থনৈতিক সুযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নের হাতিয়ার হতে পারে। কিন্তু যদি কৌশলগত ভারসাম্য হারায়, তবে এটি আঞ্চলিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের জন্য জটিল পরিস্থিতি তৈরি করবে।
আপনার মতামত জানানঃ