
গাজা যুদ্ধের দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগে ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, যিনি নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে বারবার সংকট পেরিয়েছেন, এবার এমন এক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন যা কার্যত একা লড়াইয়ের সমান। তাঁর প্রস্তাব—গাজা সিটি দখল করা—ইসরায়েলের সামরিক নেতৃত্ব, আন্তর্জাতিক মিত্র এমনকি দেশীয় জনমতের বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়েও অনুমোদন পেয়েছে।
নেতানিয়াহুর এই পরিকল্পনার পেছনে রাজনৈতিক হিসাব স্পষ্ট। সামরিক বাহিনী বলেছে, এই অভিযান গাজার মানবিক বিপর্যয় বাড়াবে এবং সেখানে থাকা ৫০ জন জিম্মির জীবন ঝুঁকিতে ফেলবে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলের অধিকাংশ মানুষ চায় যুদ্ধ থামুক এবং বন্দীরা নিরাপদে ফিরুক। কিন্তু নেতানিয়াহু জানেন, যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলে তাঁর কট্টর ডানপন্থী জোটসঙ্গীরা ক্ষুব্ধ হয়ে সরকার ভেঙে দিতে পারেন। সেই জোটে আছেন উগ্রপন্থী দুই নেতা—ইতামার বেন গভির ও বেজালেল স্মোট্রিচ—যাঁরা গাজা পুরোপুরি দখল করে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপন এবং পরিশেষে অঞ্চলটিকে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করার স্বপ্ন দেখছেন। তাঁদের কাছে নেতানিয়াহুর বর্তমান পরিকল্পনা অর্ধেক-অসফল পদক্ষেপ, যা কেবল রাজনৈতিক নাটক হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি নেতানিয়াহুকে এক অদ্ভুত কৌশলের দিকে ঠেলে দিয়েছে—যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা। তিনি পরিকল্পনাটি এমনভাবে সাজিয়েছেন যাতে দুই মাসের সময়সীমা রেখে দেওয়া হয়। এতে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি বিনিময়ের সুযোগ রাখা হয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে অভিযান শুরু করার আইনি ও রাজনৈতিক অনুমোদনও নিশ্চিত করা হয়েছে। এক অর্থে, এটি একধরনের সময় কেনার উপায়, যাতে তিনি এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিয়ে পরিস্থিতি নিজের পক্ষে ঘোরাতে পারেন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই পদক্ষেপ ইসরায়েলকে আরও বিচ্ছিন্ন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থন থাকলেও ইউরোপে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তীব্র হচ্ছে। জার্মানি সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি স্থগিত করেছে, যা অন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্যদের জন্যও উদাহরণ হতে পারে। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের পর ইসরায়েলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র। গাজায় খাদ্যসংকট ও অনাহার বেড়ে চলায় যুদ্ধের নৈতিকতা আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডার ইয়াল জামির স্পষ্ট করে বলেছেন, গাজায় নতুন অভিযান হবে ইসরায়েলের জন্য এক “ফাঁদ”, যা দীর্ঘমেয়াদে সেনাদের মনোবল ও সক্ষমতা ক্ষয় করবে। প্রায় দুই বছর ধরে অবিরাম লড়াইয়ে ক্লান্ত সেনাদের জন্য এটি নতুন চাপে পরিণত হবে এবং একই সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের মানবিক বিপর্যয় অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছাবে।
এভাবে নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা দেশ-বিদেশে সমর্থনহীন হয়েও এগোচ্ছে, কারণ এটি তাঁর রাজনৈতিক টিকে থাকার হাতিয়ার। তিনি জানেন, যুদ্ধ থামালে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়বে, আর পূর্ণাঙ্গ গাজা দখলের পথে গেলে সামরিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি আছে। তাই ধাপে ধাপে অভিযান এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে তিনি দুই দিকের চাপ সামলানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এর মূল্য দিচ্ছে গাজার সাধারণ মানুষ ও বন্দীরা, যারা প্রতিদিন ভয়, ক্ষুধা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে বেঁচে আছে।
এই পরিস্থিতি প্রমাণ করছে যে ইসরায়েলের বর্তমান নেতৃত্ব যুদ্ধকে শুধু সামরিক সংঘাত হিসেবে নয়, রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রশ্ন হিসেবেও দেখছে—যেখানে মানবিক মূল্য ও আন্তর্জাতিক সুনামের চেয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ