২০২৪ সালের আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে ধারাবাহিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এসব পদক্ষেপের ফলে মাত্র এক বছরের মধ্যে সরকার মোট ১৪ হাজার ১৩১ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জ্বালানি খাতের দীর্ঘদিনের অদক্ষতা, উচ্চমূল্যের আমদানি এবং অনিয়ন্ত্রিত প্রকল্প ব্যয়ের কারণে যে আর্থিক চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, তা কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে এসব উদ্যোগের ফলে।
সরকার প্রথমেই ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ বাতিল করে এবং ২০০৮ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস অনুসরণে ফিরে আসে। এর ফলে জ্বালানি আমদানিতে প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। এই নীতির আওতায় ২৩টি সংস্থার মাধ্যমে কম প্রিমিয়ামে ৪৯ কার্গো জ্বালানি কেনা হয়, যাতে ৩০২ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় হয়। পাশাপাশি এলএনজি আমদানিতেও ব্যয় কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। গত জুলাইয়ে ওমানভিত্তিক ওকিউ ট্রেডিং লিমিটেডের সঙ্গে পেট্রোবাংলা স্বল্পমেয়াদি চুক্তি করে, যা থেকে আরও ৩০৮ কোটি টাকা বাঁচে।
এছাড়া সরকার দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে কনসোর্টিয়াম গঠন করে বিশ্বব্যাংকের আইডিএ গ্যারান্টি সুবিধা কাজে লাগায়। এই সুবিধা ২০২৭ সাল থেকে দ্বিগুণ হয়ে ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে, যা থেকে সাত বছরে মোট ২,৭৭২ কোটি টাকার সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান এবং কার্যকর সরকার টু সরকার আলোচনার মাধ্যমে জ্বালানি আমদানির খরচ আগের অর্থবছরের তুলনায় ৭,০৫৪ কোটি টাকা কমানো হয়।
জ্বালানি খাতের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমেও খরচ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে পাথর ভাঙার বিস্ফোরক ক্রয়ে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও কাফকোর মধ্যে চুক্তি করে বছরে ৬৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়। একইভাবে, জালালাবাদ গ্যাস ও লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি বছরে আরও ৪৬৩ কোটি টাকার রাজস্ব যোগ করে।
সিস্টেম লস কমাতেও রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়, যার ফলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সিস্টেম লস হ্রাস পেয়ে ২১৮ কোটি টাকার সাশ্রয় হয়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন খুচরা পর্যায়ে গ্যাসের দাম কমালেও শিল্প ও ক্যাপটিভ টায়ারের জন্য দাম পুনর্নির্ধারণ করে, যা থেকে বছরে অতিরিক্ত ৯৮ কোটি টাকার রাজস্ব আসবে। পাশাপাশি বাপেক্স ১৯টি কূপের অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার করে জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন ৮২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যোগ করে, যা থেকে প্রায় ১,৯৪৩ কোটি টাকার সাশ্রয় হয়।
বিভিন্ন প্রকল্পেও ব্যয় কমানোর সাফল্য দেখা গেছে। সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং ও ডাবল পাইপলাইন প্রকল্প থেকে ১৯৩ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম-ঢাকা জ্বালানি পাইপলাইন থেকে ৪৫ কোটি টাকা, বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট-হরিপুর গ্যাস ট্রান্সমিশন প্রকল্প থেকে ৩১ কোটি টাকা, এবং গ্যাস স্টেশন সংস্কার প্রকল্প থেকে ২৭ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। একইভাবে ইস্টার্ন রিফাইনারি ও বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস লাইন থেকেও প্রায় ১৮ কোটি টাকা বাঁচানো হয়েছে।
তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ ও মেঘনা গ্যাসক্ষেত্রে সাতটি কূপের ওয়ার্কওভার থেকে ৬ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় হয়েছে, আর রংপুর ও আশপাশের এলাকায় গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ক নির্মাণে সাশ্রয় হয়েছে আরও ৩ কোটি টাকার বেশি। কর্ণফুলী গ্যাসের প্রিপেইড মিটার প্রকল্প এবং ফৌজদারহাট-সীতাকুণ্ড-মিরসরাই গ্যাস নেটওয়ার্ক উন্নয়ন কাজ থেকেও মোট কয়েক কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের এই পদক্ষেপগুলো শুধু খরচ কমানো নয়, বরং রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং জ্বালানি খাতের দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকেও অগ্রসর করছে। যদিও ভবিষ্যতে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তবুও এই এক বছরের সাফল্য প্রমাণ করে—দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে জ্বালানি খাতে বিশাল অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় সম্ভব।
আপনার মতামত জানানঃ