উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে বিমান বাহিনীর একটি ‘এফ-সেভেন বিজিআই’ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২০ জন, আহত হয়েছেন আরও দেড় শতাধিক। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা কেবল একটি যান্ত্রিক ত্রুটির ফল নয়—পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অস্ত্র কেনা নিয়ে দুর্নীতির এক গোপন অধ্যায়, যেটি বাংলাদেশে নিরাপত্তার চেয়ে লুটপাটকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
চীনের তৈরি এই ‘এফ-সেভেন বিজিআই’ যুদ্ধবিমানগুলো ২০১১ সালে শেখ হাসিনার সরকারের সময় চীনের কাছ থেকে কেনা হয়। বিমান বাহিনী তখন ১৬টি যুদ্ধবিমান সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৩ সালে এগুলো বহরে যুক্ত হলেও, একই বছর চীন এই মডেলের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। প্রশ্ন জাগে—যখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এই পুরনো প্রযুক্তির ফাইটার থেকে সরে আসছে, তখন বাংলাদেশ কেন এমন একটি বিমানে বিনিয়োগ করল?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘এফ-সেভেন বিজিআই’ আদতে সোভিয়েত যুগের মিগ-২১ এর আধুনিকায়িত সংস্করণ মাত্র। এমন একটি মডেল, যার উৎপাদন চীন নিজেই বন্ধ করে দিয়েছে, সেটিকে “আধুনিক যুদ্ধবিমান” হিসেবে উপস্থাপন করে কেনা হয়েছিল। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘ইকোনমিক টাইমস’ এই বিমানকে ‘কম খরচে তৈরি’ বলে উল্লেখ করেছে, যা একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়—মানবিক নিরাপত্তা নয়, বরং কম বাজেটে চুক্তি করাই ছিল প্রধান বিবেচ্য।
এই কম দামের চুক্তির আড়ালে ছিল একাধিক কমিশনভিত্তিক লেনদেন। প্রতিরক্ষা খাত সবসময়ই বাংলাদেশের সবচেয়ে গোপনীয় ও জবাবদিহিতাহীন খাতগুলোর একটি। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অভিযোগ অনুযায়ী, অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান কেনাকাটায় বড় অংকের ঘুষ লেনদেন হয়, যেটা শুধু সামরিক বাহিনীর কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নয়—রাজনীতিকদের সাথেও ভাগাভাগি হয়। শেখ হাসিনার সময় এই ধরনের কেনাকাটায় কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থা ছিল না। সংসদে এই চুক্তি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি, এমনকি গণমাধ্যমও তেমনভাবে প্রশ্ন তোলেনি।
আজকের এই ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা সেই দুর্নীতির কুফল হিসেবেই দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর রেকর্ড বলছে, গত এক দশকে অন্তত তিনটি ‘এফ-৭’ সিরিজের বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছে। ২০১৮ সালে মধুপুরে এবং ২০২১ সালে বঙ্গোপসাগরে ঘটে আরও দুটি দুর্ঘটনা, যেখানে বিমানের মডেল ছিল একই রকম। এরপরও কেন এই পুরনো, ঝুঁকিপূর্ণ মডেল দিয়ে বিমান বাহিনী চালানো হচ্ছে?
বিমান দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে সামরিক দক্ষতা ও প্রস্তুতি নিয়েও। একদিকে সরকার মোটা অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ করছে, অন্যদিকে পুরনো, জীবনহানিকর প্রযুক্তির ব্যবহারই প্রমাণ করে যে প্রকৃত উন্নয়ন নয়, বরং দুর্নীতিই ছিল মূল লক্ষ্য।
এমন ভয়ংকর ঘটনার পরও সরকার, সেনাবাহিনী বা বিমান বাহিনী থেকে কোনো কার্যকর তদন্তের আশ্বাস আসেনি। বরং আন্তঃবাহিনীর জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) একটি দায়সারা বিবৃতিতে বলেছে, বিমানটি উড্ডয়নের ১২ মিনিটের মাথায় বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু কেন তা হলো? কী কারণে এভাবে একটি যুদ্ধবিমান রাজধানীর জনবহুল স্কুল এলাকায় বিধ্বস্ত হলো? এর দায় কে নেবে?
শেখ হাসিনার সরকারের শেষদিকে প্রতিরক্ষা খাত নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠেছিল। আমলে চলাকালীন প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলোর স্বচ্ছতা নিয়ে তখনও কোনো তদন্ত হয়নি। হাসিনা নিজেই চীন ও ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলো করতেন সরাসরি প্রশাসনিকভাবে, কোনোরূপ সংসদীয় অনুমোদন ছাড়াই। এসব চুক্তির আড়ালে কী ছিল—তা জানার সুযোগ কখনো জনগণ পায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক যুগে প্রতিরক্ষা খাতে প্রযুক্তির পরিবর্তন খুব দ্রুত ঘটে। অথচ বাংলাদেশের মতো একটি দেশ এখনও ১৯৬০–এর দশকের রুশ বিমানের উন্নত সংস্করণ ব্যবহার করছে, তা কেবল প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা নয়—এটা একটি রাজনৈতিক ব্যর্থতা।
আজ যারা মারা গেছেন, তারা শুধুমাত্র একটি দুর্ঘটনার শিকার নন। তারা একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমের বলি। এমন একটি সিস্টেম, যেখানে জীবন নয়, কমিশন বেশি মূল্যবান। শেখ হাসিনা ও তার আমলের সামরিক চুক্তিগুলোর পূর্ণাঙ্গ নিরপেক্ষ তদন্ত এখন সময়ের দাবি। এবং এক্ষেত্রে দায় শুধু বিমান বাহিনী বা পাইলটের নয়—এর দায় রাষ্ট্রের, সরকারের, এবং সেইসব সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর, যারা জনগণের জীবনের বিনিময়ে নিজেদের স্বার্থকেই বড় করে দেখেছে।
আপনার মতামত জানানঃ