পটুয়াখালীর বদরপুর ইউনিয়নের খলিশাখালী গ্রামে একটি নিপাট পারিবারিক দ্বন্দ্ব অপ্রত্যাশিতভাবে তুলে ধরেছে সরকার প্রদত্ত শহীদ তালিকার এক ভয়াবহ বিকৃতি। এ ঘটনাটি শুধু শহীদ তালিকার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না, বরং অনুদানের টাকার প্রলোভনে কীভাবে মানুষ নৈতিকতার সীমারেখা লঙ্ঘন করতে পারে, সেটিরও একটি অনুপম দৃষ্টান্ত।
গত বছর ১৫ নভেম্বর ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বশির সরদার নামে এক ব্যক্তি। তাঁর পরিবারের দাবি ছিল, তিনি ২০২৫ সালের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে আহত হয়ে মারা গেছেন এবং সেই সূত্রে তাঁকে ‘শহীদ’ ঘোষণা করে সরকার ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও জেলা প্রশাসন ২ লাখ টাকা অনুদান দেয়। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে পারিবারিক অর্থ বণ্টন নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে বশিরের ভাই নাসির উদ্দিন নিজেরই প্রদত্ত মিথ্যা দাবিকে প্রত্যাহার করে লিখিত অভিযোগ জমা দেন জেলা প্রশাসকের কাছে।
নাসিরের অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে শহীদ তালিকা থেকে বশির সরদারের নাম বাতিলের সুপারিশ করেন। তিনি তার চিঠিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, বশির কোনো গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেননি বরং লোহার আঘাতে পায়ে আঘাত পেয়ে মারা যান—এমনটাই নথিভুক্ত।
তবে পুরো ঘটনার মোড় ঘুরেছে বশিরের স্ত্রী রেবা আক্তারের বক্তব্যে। তিনি দাবি করেছেন, পরিবার চরম আর্থিক সংকটে পড়ে বশিরের মৃত্যুকে আন্দোলনের সঙ্গে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। মূল পরিকল্পনার পেছনে ছিলেন নাসির উদ্দিন নিজেই। তিনি পরিবারকে বুঝিয়ে শহীদ তালিকায় নাম তোলার ব্যবস্থা করান। কিন্তু সরকার থেকে আসা ১২ লাখ টাকার অনুদানের একটি বড় অংশ দাবি করলে, রেবা তাতে রাজি না হওয়ায় ভাই নাসির ক্ষুব্ধ হয়ে পুরোনো ঘটনাকে সামনে এনে অভিযোগ দেন ডিসির কাছে।
অন্যদিকে, বশিরের বাবা সেকান্দার সরদার পুরো বিষয়টি ঘুরিয়ে বলেন। তাঁর দাবি, বশিরের চিকিৎসায় তিনি পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেছেন, অথচ রেবা আক্তার পুরো টাকাই নিজের নামে রেখে দিয়েছেন। তাই ন্যায়বিচার চেয়ে বড় ছেলে নাসির জেলা প্রশাসকের কাছে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরেন।
এই ঘটনায় উঠে আসে বহুস্তরীয় এক বাস্তবতা। একদিকে এটি উদ্ঘাটন করে রাষ্ট্রীয় সহানুভূতির অপব্যবহার এবং অন্যদিকে দেখায়, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কীভাবে পরিবারগুলোকে অনৈতিক পথে ঠেলে দিতে পারে। একইসঙ্গে প্রশ্ন তোলে শহীদ তালিকা তৈরির প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাইয়ের দুর্বলতা নিয়েও। স্থানীয় ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ক সজীবুল ইসলামের মতে, পরিবার নিজেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে আন্দোলনের সময় বশির আহত হয়েছেন বলে দাবি করে, যাতে সরকারী অনুদান পাওয়া যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভুয়া শহীদ তালিকার অন্তর্ভুক্তির ঘটনা কি নিছক একটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ, নাকি এর পেছনে রয়েছে কোনো বড় দুর্নীতির চক্র? শহীদ তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের যাচাই কী এতটাই দুর্বল যে, একটি পরিবারের কল্পিত বর্ণনার ভিত্তিতেই কাউকে ‘শহীদ’ ঘোষণা করা যায়?
জেলা প্রশাসকের পদক্ষেপ অবশ্য দ্রুত ও প্রশংসনীয়। তিনি নিহত পরিবার ও স্থানীয়দের বক্তব্য যাচাই করে একটি সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে বিষয়টি কেন্দ্রীয়ভাবে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন দেখার বিষয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কত দ্রুত ও কীভাবে এই অনিয়ম সংশোধনে ব্যবস্থা নেয়।
ঘটনার পেছনের প্রেক্ষাপট ঘাঁটলে বোঝা যায়, একদিকে যেমন দারিদ্র্য ও অসহায়ত্ব পরিবারকে অনিয়মে ঠেলে দিয়েছে, অন্যদিকে সরকারী সহানুভূতির এমন দুর্বল ব্যবস্থাপনা দিচ্ছে অপব্যবহারের সুযোগ। বশিরের স্ত্রী নিজের দিক থেকে হয়তো একটি বাস্তবতা তুলে ধরেছেন—স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। কিন্তু সেই বাস্তবতা কীভাবে একটি মিথ্যাচারকে আইনি স্বীকৃতি দিতে পারে? আর সেই মিথ্যাচারেই যখন পরিবার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে, তখন সত্য উঠে আসে অনিচ্ছাকৃতভাবেই।
এই ঘটনাটি যেন আরেকবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, রাষ্ট্রীয় সহানুভূতি বিতরণে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও নৈতিকতার কোনো বিকল্প নেই। শহীদদের তালিকা কেবল একটি সম্মাননা নয়, এটি ইতিহাসের দলিল। সেখানে একটি ভুল নামও কেবল মর্যাদাহানি নয়, বরং প্রকৃত শহীদদের প্রতি অবিচার।
সরকার যদি সত্যিই শহীদদের সম্মান বজায় রাখতে চায়, তবে তালিকা তৈরির প্রক্রিয়ায় আরও শক্তিশালী যাচাই ব্যবস্থা, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আলাদা পর্যালোচনা এবং মিথ্যাচারের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থাও করতে হবে। আর সমাজকেও ভাবতে হবে, অনুদানের অর্থ কেবল অর্থ নয়—এটি নৈতিক দায়বদ্ধতারও প্রতিচ্ছবি। সেই দায় যদি পরিবার নিজেই ভঙ্গ করে, তবে সমাজের আর্তনাদ শুধু অর্থের জন্যই নয়, মূল্যবোধের জন্যও হবে।
পটুয়াখালীতে শহীদ তকমা পেতে দেওয়া মিথ্যা তথ্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া একটি পরিবারের গল্প যেন আমাদের জন্য সতর্ক সংকেত। সরকার, সমাজ এবং প্রতিটি পরিবারকে এখনই ভাবতে হবে—ভবিষ্যতের শহীদদের সম্মান রক্ষায় আজকের মিথ্যাচারকে কীভাবে রোধ করা যায়।
আপনার মতামত জানানঃ