ঠিক এই মুহূর্তে নির্বাচনপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতির যে জটিল মানচিত্রটি আঁকা হচ্ছে, তার কেন্দ্রে এসে দাঁড়িয়েছে তিনটি শক্তি—বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্য ঘোষণা করার পর মনে হয়েছিল আস্থাহীনতার বরফ খানিকটা গলবে। কিন্তু জুলাই সনদ—অর্থাৎ সংস্কার, বিচারপ্রক্রিয়া ও ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্গঠনের যে খসড়া রূপরেখা—তা কীভাবে এবং কার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে, সেটি নিয়েই নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। জামায়াত ও এনসিপি বলছে, নির্বাচন আগে—সনদের আইনি ভিত্তি ও দৃশ্যমান বাস্তবায়ন পরে—এই সূত্র মেনে নিলে পুরো প্রক্রিয়া ‘ডিজাইনড’ হয়ে যাবে। বিএনপি উল্টো বলছে, সনদের অধিকাংশ প্রয়োগ হবে নির্বাচিত সংসদে; নির্বাচন-সম্পর্কিত ন্যূনতম নিয়ম-কানুন ও পরিবেশ নিশ্চিত করলেই ভোটে যাওয়া সম্ভব। এই ‘এখন না পরে’ দ্বন্দ্বই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রধান জ্বালানি।
জুলাই ঘোষণাপত্রকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার কথা এনসিপি ক্রমাগত জোর দিয়ে আসছে। তাদের বক্তব্য, সংস্কার, বিচার ও ক্ষমতার জবাবদিহির প্রশ্নে দৃশ্যমান অগ্রগতি ছাড়া ফেব্রুয়ারির ভোটে যাওয়া মানে হচ্ছে পুরনো কাঠামোর ওপর নতুন রংতুলি বুলিয়ে দেওয়া। এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনেরা প্রকাশ্য সমাবেশ ও ব্রিফিংয়ে বলেছেন—এই শর্ত মানা না হলে নির্বাচনই নতুন সংকটের জন্ম দেবে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দলের ভিতরের কিছু কণ্ঠ, যারা প্রকাশ্যে বলছে—ফেব্রুয়ারির ভোট “হবে না” বা “হওয়া উচিত নয়”—যদি সনদের বাস্তবায়ন না এগোয়। ফলে অনেকে ধরে নিচ্ছেন, এনসিপি এক ধাপ এগিয়ে ‘চাপ সৃষ্টির রাজনীতি’তে নেমেছে: দরকষাকষির স্পেস বাড়ানো, আসন-সমঝোতার সম্ভাবনা খোলা রাখা এবং নিজদের ‘ভোটব্যাঙ্ক’ আকারে উপস্থিতি অনুভব করানো—সবটাই একসঙ্গে।
জামায়াতের সমীকরণটি অন্যরকম। তাদের সংগঠিত কর্মীবাহিনীর শক্তি আছে, কিন্তু বিস্তৃত জনসমর্থনের প্রশ্নে তারা ঐতিহাসিকভাবে সীমাবদ্ধ। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিত রাজনৈতিক মাঠে বিএনপি এখন অনেক বড় ব্রড-কোয়ালিশন-সদৃশ সমর্থন টানছে—এমন একটি ধারণা রূপ নিচ্ছে। এই বাস্তবতায় জামায়াতের প্রধান শঙ্কা—খেলাটা অসমতল হয়ে যাচ্ছে কি না। তাই তারা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থেকে শুরু করে ভোটপদ্ধতির রূপান্তর—আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR)—পর্যন্ত কাঠামোগত দাবি তুলছে। এতে তাদের দুইটি লাভ: এক, খেলার নিয়ম বদলাতে পারলে আসন পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে; দুই, ভোটের আগে এই চাপ অব্যাহত রাখলে আলোচনার টেবিলে ওদের ওজনও বাড়ে। বিএনপি অবশ্য PR পদ্ধতির বিরোধিতায় অনড়—যুক্তি, এটি আলোচ্যসূচির মূল এজেন্ডাই ছিল না এবং এখন এই দাবি তোলা আসলে নির্বাচন বিলম্বিত বা ভণ্ডুল করার কৌশল। টেবিলের একপাশে তাই ‘পদ্ধতি বদলাও’, অন্যপাশে ‘পদ্ধতি এখন নয়’—দুটি ন্যারেটিভ পাশাপাশি দৌড়াচ্ছে।
বিএনপির জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক গাণিতিক প্রশ্ন—কীভাবে তারা ফেব্রুয়ারির সময়রেখা, সনদের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা, এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন—এই তিনটিকে এক সুতায় গাঁথবে। লন্ডন বৈঠক—যেখানে প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমান যৌথভাবে ফেব্রুয়ারিতে ভোটের বিষয়ে একমত হয়েছেন—এই ইভেন্টটি জামায়াত-এনসিপি দু’দলের কাছেই ‘সিগন্যালিং’ হিসেবে ধরা পড়েছে: রাষ্ট্র-রাজনীতির সিদ্ধান্ত কি কোনো এক দলের সঙ্গে সমঝোতার ভিতরে গঠিত হচ্ছে? এখানেই তারা ‘ডিজাইনড ইলেকশন’-এর আশঙ্কা তুলছে, আর বিএনপি বলছে—এটি কেবল একটি সময়রেখা-সমঝোতা; নির্বাচনী পরিবেশের ন্যূনতম রূপরেখা (প্রশাসন নিরপেক্ষতা, মাঠের নিরাপত্তা, মামলা-মোকদ্দমা নরম করা, গণমাধ্যম চলাচল) নিশ্চিত করেই ভোট হবে। এই পার্থক্য প্রকৃতপক্ষে ‘কী আগে’ এবং ‘কী পরে’—এই ক্রমতালিকার রাজনীতি।
এখানে অন্তবর্তী সরকারের ক্যালকুলেশনটাও বোঝা দরকার। একদিকে তারা বলছে—সময় ঘোষণার পর এখন নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দলগুলোর টেকনিক্যাল আলোচনা চলবে; সংবিধান-সংস্কার বা জুলাই সনদের বিচার-বিশ্লেষণ হবে নির্বাচনের পর নির্বাচিত সংসদে। অন্যদিকে, সরকারের ভেতরেই নাকি ফেব্রুয়ারির সময়সীমা নিয়ে মতানৈক্য আছে—এমন ইঙ্গিত রাজনীতিতে ঘুরছে। ফলে সরকার আপাতত ‘টাইমলাইন ধরে রাখো, তফসিল-প্রস্তুতি এগোয়’—এই নীতিতে হাঁটছে; কিন্তু মাঠে যদি টানা কর্মসূচি ও সংঘাত বাড়ে, তখন ‘ল’অ্যান্ড অর্ডার’–এর যুক্তিতে কঠোর হওয়াও অসম্ভব নয়। অর্থাৎ, সরকারের স্ট্র্যাটেজি—সময়সূচি স্থির রেখে চাপ-রাজনীতিকে ‘ম্যানেজ’ করা; আর ‘ম্যানেজ’ ব্যর্থ হলে শক্তিশালী প্রশাসনিক বার্তা।
এভাবে দেখলে, বিএনপি মাঝখানে পড়ে গেছে এক অদ্ভুত ‘ডাবল-বাইন্ড’-এ। একদিকে জামায়াত-এনসিপি যদি ভোট বর্জনের দিকে যায়—অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে বিএনপিও খুঁতখুঁতে সমালোচনার মুখে পড়বে; অন্যদিকে, যদি বিএনপি তাদের শর্তগুলোর সঙ্গে সুর মেলায়—ফেব্রুয়ারির টাইমলাইন শিথিল হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে, যা তাদের বর্তমান জনমতের ঢেউকে মিইয়ে দিতে পারে। তাই বিএনপির কৌশলগত ভঙ্গি এখন—মাঠে আশাবাদী বক্তৃতা, টেবিলে ‘মিনিমাল’ রিফর্মের তালিকা, আর জনতার কাছে ‘এখনই ভোট দরকার’—এই বার্তা পৌঁছানো। দলটি বুঝছে, দীর্ঘায়িত ট্রানজিশন জনসাধারণের ধৈর্য ক্ষয় করে; অতএব সময়সীমা ধরে রাখতে পারলে ‘ভোট-ইজ-ইনইভিটেবল’ ন্যারেটিভ তাদের পক্ষেই যায়।
জামায়াতের দৃষ্টিকোণে, ফেব্রুয়ারি বেঁধে দিলে ‘গেম-থিওরি’ তাদের বিপক্ষে যেতে পারে। কারণ বিস্তৃত জনমতের তরঙ্গে বিএনপির একক প্রভাব বাড়লে আসন-অংক সংকুচিত হয়। তাই তারা ভোটপদ্ধতি বদলের দাবিকে কেন্দ্র করে ‘রুলস অফ দ্য গেম’–এ পরিবর্তনের প্রস্তাব তুলছে। একই সঙ্গে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’—অর্থাৎ প্রশাসন, মাঠ, মামলা, মিছিল, মিডিয়া—এই পাঁচ ‘এম’-এর ভারসাম্য নিশ্চিত করার প্রশ্নে তাদের অবস্থান আরও কর্কশ। রাজনীতির ভাষায় এটি ‘বিডিং-আপ দ্য প্রাইস’: নিয়মের দাম বাড়াও, তা না হলে গেমে ঢোকা কঠিন। বিএনপির চোখে—এটি অযৌক্তিক সর্বোচ্চ দর হাঁকা, যাতে সময় টেনে নেওয়া যায়। এনসিপি এখানে ‘রিফর্ম-ফার্স্ট’ আদর্শিক রেখা ধরে নিজস্ব পরিচয় পোক্ত করার চেষ্টা করছে—জনমনে যে নৈতিক উচ্চভূমি তারা জুলাই-অভ্যুত্থানের সময় পেয়েছিল, সেটি ধরে রাখার প্রয়াস।
এই ত্রিভুজ-রাজনীতিতে আরেকটি লুকোনো সমীকরণ কাজ করছে—সকলেই ‘ভবিষ্যৎ ক্ষমতা-বিন্যাস’ নিয়ে পূর্বচুক্তির ইশারা খুঁজছে। যেমন, এনসিপির ভেতরে কেউ কেউ যখন প্রকাশ্যে বলেন যে ফেব্রুয়ারিতে ভোট হবে না, তখন সেটি কেবল হতাশার মন্তব্য নয়; এটি আলোচনার টেবিলে জোর বাড়ানোর একধরনের সিগন্যালও—“প্রথমে সনদ, তারপর ভোট”। একইভাবে, বিএনপি যখন জোর দিয়ে বলে—সব দলই শেষ পর্যন্ত ভোটে যাবে—তখন সেটিও আত্মবিশ্বাস দেখানো ছাড়াও ‘অপরিবর্তনীয় টাইমলাইন’–এর বার্তা, যাতে ‘কেউ না এলে’ দায় তাদের ঘাড়ে না পড়ে। এই ‘দায় কার’—এই খেলাই শেষ পর্যন্ত ‘বয়কট বনাম অংশগ্রহণ’-এর সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করবে।
ভবিষ্যৎ দৃশ্যপটে কয়েকটি পথ খোলা
শর্ত-শিথিল সহমত: জুলাই সনদের কিছু অংশ—যেমন নির্বাচন-সম্পর্কিত ন্যূনতম সংস্কার, বিএনপির দাবি করা প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ—এগুলোতে অগ্রগতি দেখিয়ে এনসিপি-জামায়াতকে ভোটমুখী রাখা। এতে ফেব্রুয়ারি বজায় থাকবে, অংশগ্রহণও বাড়বে। কিন্তু এতে সরকারের হাতে দ্রুত আইনি-প্রক্রিয়াগত সমন্বয় দরকার—যা টেকনিক্যালি কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়।
The Financial Express
কড়া শর্ত, নরম সময়: এনসিপি-জামায়াত তাদের শর্তে অনড় থাকলে—সরকার সময়সূচি না বদলালে—তারা ‘হার্ডলাইন’ কর্মসূচিতে যেতে পারে, কৌশলে নরম বা কঠিন বয়কটের ইঙ্গিতও রাখতে পারে; ভোটে অংশ নিলেও সীমিত সংখ্যক আসনে প্রার্থী দেওয়া, বা জোট-প্রকৌশলে সময়ক্ষেপণ। এতে ভোট হবে বটে, কিন্তু ‘ইনক্লুসিভিটি’ প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাবে।
সংঘাত-ড্রাইভেন বিলম্ব: লাগাতার কর্মসূচি যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ করে, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতিতেও চাপ পড়ে—তাহলে সময়রেখা নড়চড় হতে পারে। তবে এ পথ বেছে নিলে দায়-দায়িত্বের তীর যার দিকে যাবে, তার রাজনৈতিক ‘মরাল হাইগ্রাউন্ড’ দ্রুত ক্ষয়ে যাবে—এ কথা সব পক্ষই বোঝে। ফলে সবাই এই পথ এড়াতে চাইবে, অন্তত মুখে।
বড় চিত্রে তাই দেখা যাচ্ছে—সব পক্ষই একধরনের ‘প্রেশার গেম’ খেলছে, কিন্তু একইসঙ্গে ‘ব্লেম গেম’–এর বোর্ডও সাজানো। জামায়াত-এনসিপি চাইছে ‘সনদ আগে, ভোট পরে’—কমপক্ষে নির্বাচন-প্রাসঙ্গিক কিছু অনুচ্ছেদে দৃশ্যমান অগ্রগতি; বিএনপি চাইছে ‘ভোট আগে, সিস্টেমিক রিফর্ম পরে’—যাতে ক্ষমতার বৈধতা ও নীতিনির্ধারণের সক্ষমতা হাতের মুঠোয় আসে; সরকার চাইছে সময়রেখা অক্ষুণ্ণ রেখে মাঠের উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা। প্রতিটি অবস্থানের পেছনে যুক্তি আছে, কিন্তু প্রতিটি যুক্তির ঝুঁকিও আছে: দীর্ঘ ট্রানজিশন জনসমর্থন ক্লান্ত করে; দ্রুত ভোটে গেলে রিফর্মের আশা ভঙ্গের ভয় থাকে; আর কঠোর প্রশাসনিক ভঙ্গি রাজনীতির বিশ্বাসের ঘাটতি আরও বাড়ায়।
অবশেষে, ফেব্রুয়ারির ভোট ‘হবে কি হবে না’—এই প্রশ্নের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—হলে তা কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হবে। এনসিপির মতো নতুন শক্তি যদি তাদের নৈতিক অবস্থান—সংস্কারপ্রথম—বাঁচিয়ে রেখেও নির্বাচনী বাস্তবতায় অংশগ্রহণের পথ খুঁজে পায়, জামায়াত যদি ন্যায্য মাঠের নিশ্চয়তা পেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে, আর বিএনপি যদি সময়সূচির ভেতরেই ন্যূনতম সংস্কারের গ্যারান্টি আদায় করতে পারে—তাহলে অনিশ্চয়তার কুয়াশা অনেকটাই কাটতে পারে। না হলে—বর্জন, সীমিত অংশগ্রহণ, বা ব্যালটে প্রতীকমাত্র উপস্থিতি—এই তিনের যে কোনো রূপই নির্বাচনী বৈধতার ওপর প্রশ্ন তুলবে, যার রাজনৈতিক খরচ শেষ পর্যন্ত সবার কাছেই ফিরে আসবে। রাজনীতি শেষমেশ সম্ভবের শিল্প; শর্ত আর সময়ের সংঘাতে যে পক্ষ ‘সমঝোতার শিল্প’ ভালো দেখাতে পারবে, ফেব্রুয়ারির ব্যালটবক্স তার পক্ষেই কথা বলবে—এমনটাই এই মুহূর্তের সবচেয়ে সম্ভাব্য পাঠ।
আপনার মতামত জানানঃ