২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ক্ষমতার পরিবর্তনের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত মানবাধিকার বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা আংশিক ইতিবাচক হলেও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়—স্থিতিশীলতার দাবি পুরোপুরি নিরপেক্ষ নয় এবং এর ভেতরে বহু অমীমাংসিত সংকট এখনও জিইয়ে আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতা ও দমনপীড়ন কমলেও সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি এখনো জটিল ও ভঙ্গুর।
প্রতিবেদনে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে গত বছরের জুলাই-আগস্টের ভয়াবহ সহিংসতা, যেখানে ছাত্রলীগ, পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং হাজারো মানুষ আহত হয়। আন্দোলন দমনে গুম, নির্বিচার গ্রেফতার, ঘরে ঘরে তল্লাশি, হাসপাতাল থেকে আহতদের তুলে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছিল। এই সময় দেশজুড়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল, বহু সাংবাদিক হয়রানির শিকার হন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনামূলক পোস্ট দেওয়ার জন্যও সাধারণ মানুষ গ্রেফতার হন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, পূর্ববর্তী সরকার প্রায় সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দায়মুক্তি দিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গুম, বেআইনি হত্যা বা নির্যাতনে জড়িত থাকার পরও তদন্ত বা বিচার হয়নি। এমনকি বিদেশে থাকা সরকারবিরোধী কণ্ঠগুলোকেও বিভিন্ন কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপে ফেলেছে তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসে পূর্ববর্তী শাসনামলের কিছু অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে এবং জাতিসংঘের সঙ্গে যৌথভাবে বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে। তবে বাস্তবতা হলো—মানবাধিকার সুরক্ষায় কাঠামোগত পরিবর্তন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতায় এখনো বড় ধরনের অগ্রগতি হয়নি। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত ক্ষমতা, বিচারব্যবস্থার ধীরগতি এবং রাজনৈতিক প্রতিশোধের সংস্কৃতি মানবাধিকার রক্ষায় বড় বাধা হয়ে আছে।
দেশের প্রকৃত মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখতে হলে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা বিবেচনা করা জরুরি। আজও গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলে পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হওয়া, শ্রমিকদের সংগঠনের স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধতা, গার্মেন্টস খাতে শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন, এবং শিশু ও নারী নির্যাতনের উচ্চহার বিদ্যমান। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, ধর্মীয় বৈষম্য এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাও মানবাধিকারের অবনতিকে নির্দেশ করে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তর্জাতিকভাবে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তে চাইলেও দেশের ভেতরে মানুষের আস্থা পুরোপুরি ফিরে আসেনি। প্রকৃত স্থিতিশীলতা আসবে কেবল তখনই, যখন রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিহিংসার রাজনীতি বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজনৈতিক হাতিয়ার না হয়ে পেশাদার দায়িত্ব পালন করবে, এবং বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদন আংশিকভাবে অগ্রগতি স্বীকার করলেও, বাস্তবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখনো নাজুক এবং পুনর্গঠনের দীর্ঘ পথ বাকি।
আপনার মতামত জানানঃ