
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত বহু বছর ধরে নানা সমস্যার জালে আটকে ছিল—অব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছতা, অতিরিক্ত ভর্তুকি নির্ভরতা আর ব্যয়বহুল চুক্তির চাপে এই খাত প্রায়শই জনআস্থা হারিয়েছে। অথচ বিদ্যুৎ শুধু আমাদের ঘর আলোকিত করে না, শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা—দেশের প্রতিটি খাতকে সচল রাখার অন্যতম চালিকাশক্তি। ঠিক এই জায়গায় এসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদ্যুৎ খাতে একযোগে সাহসী, সাশ্রয়ী ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, যার প্রভাব ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
প্রথম বড় পদক্ষেপ ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ রহিত করা। দীর্ঘদিন ধরে এই আইনের আওতায় চুক্তিগুলো হয়ে আসছিল নানা সমালোচনা আর স্বচ্ছতার অভাবে ভরপুর। আইন রহিত করার সঙ্গে সঙ্গে সরকার দুটি কমিটি গঠন করেছে—একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি ও একটি জাতীয় কমিটি—যারা পূর্ববর্তী চুক্তি পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতে আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর চুক্তির পথ তৈরি করবে। একইসঙ্গে বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে এবং নীতিগত সংস্কারের রূপরেখা দিতে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘পলিসি ফর এনহ্যান্সমেন্ট অব প্রাইভেট পার্টিসিপেশন ইন দ্য পাওয়ার সেক্টর, ২০২৫’, যা এখন সংশ্লিষ্ট পক্ষের মতামতের জন্য উন্মুক্ত।
আর্থিক সাশ্রয় ছিল সংস্কারের আরেকটি মূল লক্ষ্য। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ভর্তুকি চাহিদা ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কমিয়ে আনা হয়েছে ৩৭ হাজার কোটিতে। এই ১০ হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় অন্য উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করবে। ব্যয় কমানোর জন্য নেওয়া হয়েছে একাধিক পদক্ষেপ—বাবিউবোর ব্যয় ১০ শতাংশ কমিয়ে মাত্র নয় মাসেই ১,৫০০ কোটি টাকা সাশ্রয়, তরল জ্বালানি আমদানির সার্ভিস চার্জ ৯% থেকে ৫%-এ নামিয়ে ৪৭০ কোটি টাকা সাশ্রয়, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ হ্রাস, ১০টি পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ, সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানির ট্যারিফ কমানো, এমনকি মুনাফা ও বোনাস স্থগিতকরণ পর্যন্ত। এসব পদক্ষেপ মিলিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা রক্ষা পেয়েছে, যা পূর্বে নানাভাবে অপচয় হতো।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সরকারের গুরুত্বও এ সময়ে নতুন মাত্রা পেয়েছে। অনুমোদন পাওয়া ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা ২০২৫’ দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করবে। এর আওতায় শুরু হয়েছে ‘জাতীয় রুফটপ সোলার কর্মসূচি’, যার মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের ছাদে সৌর প্যানেল বসিয়ে ২,০০০-৩,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করা হবে। তাছাড়া ৫৫টি স্থানে মোট ৫,২৩৮ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগও চলমান। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা শুধু শক্তি উৎপাদনই নয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্যও যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে।
গ্রাহকসেবার মানোন্নয়নে সরকার মৌসুমি চাহিদা—গ্রীষ্ম, রমজান ও সেচ মৌসুমে—লোডশেডিংমুক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা নিয়েছে। অনলাইন সংযোগ প্রক্রিয়া সহজতর করতে কমিটি গঠন, বকেয়া বিল আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ, মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব বণ্টন—এসব মিলিয়ে ইতোমধ্যেই হাজার কোটি টাকার বকেয়া আদায় সম্ভব হয়েছে।
সবশেষে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন রেকর্ড—২০২৫ সালের ২৩ জুলাই ১৬,৭৯৪ মেগাওয়াট—শুধু প্রযুক্তিগত সক্ষমতাই নয়, বরং সরকারের সংকল্পকেও তুলে ধরে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ চাহিদার পূর্বাভাস (লোড ফোরকাস্ট) আরও নির্ভুল করতে কমিটি গঠন হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।
এই পুরো প্রক্রিয়া প্রমাণ করে, বিদ্যুৎ খাতে বর্তমান সরকারের লক্ষ্য শুধু উৎপাদন বাড়ানো নয়, বরং একটি টেকসই, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব শক্তি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। সংস্কার, সাশ্রয়, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও গ্রাহকসেবার সমন্বয়ে এই পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকে এমন এক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে জ্বালানি হবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নের নির্ভরযোগ্য ভিত্তি।
আপনার মতামত জানানঃ