
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত বর্তমানে এক জটিল আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার অনেক পরিমাণ বকেয়া ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করলেও নতুন করে আবারও বকেয়ার চক্র তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রায় ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ রেখে গিয়েছিল, যা প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকার সমান। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এপ্রিল পর্যন্ত এর মধ্যে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। কিন্তু এরপরও ঋণ ও বিল পরিশোধের দায় থেকে মুক্তি পাওয়া যায়নি।
সরকার বৈদেশিক ঋণের পাশাপাশি স্থানীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বকেয়া বিল পরিশোধে বিশেষ বন্ডের উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে। এই বিশেষ বন্ডের মধ্যে সার ও বিদ্যুতের প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া ছিল, যার বেশির ভাগই বিদ্যুৎ খাতে। তবুও বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ চললেও বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর পাওনা ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে বিপিডিবির (বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) কাছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বকেয়া জমেছে।
বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর মালিকদের দাবি, চলতি বছরের মার্চ থেকে নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ হচ্ছে না। ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বকেয়া প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা, বাকি অংশ গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। ফলে তারা ঋণ শোধ, মেরামত কাজ, এমনকি জ্বালানি বিল পরিশোধেও সমস্যায় পড়ছে। বিপিডিবির এক কর্মকর্তা জানান, বিল পরিশোধের গতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভর্তুকির ওপর নির্ভর করছে। ভর্তুকির টাকা সময়মতো ছাড় না হলে বিল পরিশোধ অসম্ভব হয়ে পড়ে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ৬২ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছিল, যাতে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের বিল পরিশোধ সহজ হয়। কিন্তু নতুন অর্থবছর ২০২৫-২৬ এ ভর্তুকি কমিয়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকায় আনা হয়েছে। এতে অনেক কোম্পানিই আবার অর্থসংকটে পড়ছে।
বিদ্যুৎ ক্রয়ে বকেয়া বিলের সমস্যা নতুন নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও এটি ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি হয়েছিল। সে সময় বিশেষ বন্ড ইস্যু করে কিছুটা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই প্রক্রিয়া দ্রুত করা হয়। ভারতের আদানি পাওয়ারের বকেয়া ৪৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয় জুন মাসে, যা পূর্ববর্তী সরকারের সময় বড় সংকট তৈরি করেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বিশেষ বন্ডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও সারের বকেয়া ২৫ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা পরিশোধ হয়েছে।
বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১৫ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট, যার বড় অংশ আসে কয়লা ও জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কোম্পানিগুলো প্রতি মাসে বিপিডিবিকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিক্রি করে। মার্চ থেকে বিল না পরিশোধ হওয়ায় বকেয়া এখন ২০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডেভিড হাসানাত বলেন, “মার্চ থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় মাসের বিল বকেয়া আছে। ফলে কোম্পানিগুলো ব্যাংক ঋণ পরিশোধে জটিলতায় পড়ছে।” তিনি জানান, ট্যারিফ সমন্বয় না হলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ কঠিন। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয়মূল্যের পার্থক্য বাড়লে সরকার ও বিপিডিবি উভয়েই চাপের মুখে পড়ে।
ইউনাইটেড পাওয়ারের মতো বড় কোম্পানিগুলোরও পরিস্থিতি একই। বিপিডিবির কাছে তাদের বকেয়া ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ২,৫০০ কোটি টাকা ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রের, আর ৫০০ কোটি টাকা গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রের। মার্চের পর থেকে তারা কোনো বিল পায়নি। এর ফলস্বরূপ, তাদের একটি কেন্দ্রের গ্যাস সংযোগও বিচ্ছিন্ন করেছে বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানি।
বিপিডিবি সূত্র জানায়, বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর বকেয়া ৩ থেকে ৭ মাস পর্যন্ত রয়েছে। ছয়টি বড় কোম্পানির বকেয়া প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা, বাকিদের ৮ হাজার কোটি টাকা।
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এসএস পাওয়ার কেন্দ্রটি বর্তমানে বিপিডিবিকে পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে, কিন্তু জুনের পর থেকে বিল পাচ্ছে না। তাদের দাবি, বিপিডিবির কাছে তাদের পাওনা সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। বিল না পাওয়ায় কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণ, কয়লা আমদানি ও ঠিকাদারদের অর্থ প্রদান ব্যাহত হচ্ছে।
এ অবস্থায় বিদ্যুৎ খাতের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে। ভর্তুকি কমে যাওয়ায় বিপিডিবির উপর চাপ বাড়ছে, আর বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো অর্থসংকটে পড়ছে। এর প্রভাব সরাসরি উৎপাদন ও জ্বালানি সরবরাহে পড়ছে। ব্যাংক ঋণ পরিশোধে জটিলতা বাড়ছে, বিদেশি ঋণের চাপও রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি বিদ্যুৎ ট্যারিফে প্রয়োজনীয় সমন্বয় না আনা হয় এবং সরকারের ভর্তুকি যথাসময়ে না আসে, তাহলে বকেয়ার এই দুষ্টচক্র থেকে খাতটি বের হতে পারবে না। এতে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছতা ও পরিকল্পনার ঘাটতি, জ্বালানি নির্ভরতা এবং চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। শুধু ঋণ পরিশোধ নয়, উৎপাদন খরচ, জ্বালানি আমদানি ও কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণেও যথেষ্ট অর্থ প্রয়োজন। সরকার ও বিপিডিবি যদি সময়মতো বিল পরিশোধ করতে না পারে, তবে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে শিল্প ও সাধারণ জনগণের ওপরও প্রভাব পড়বে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত এখন এক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে। সরকার একদিকে ঋণ পরিশোধে চাপ সামলাচ্ছে, অন্যদিকে নতুন বকেয়া জমছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত ট্যারিফ, ভর্তুকি ও বিল ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য আনা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতের এই আর্থিক সংকট কাটানো সম্ভব হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ