
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে এ খাত নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন উঠেছিল, কিন্তু সেসব প্রশ্ন কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে খতিয়ে দেখা হয়নি। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন সেই সব সন্দেহকে বাস্তব রূপ দিয়েছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ দুর্নীতি, অপচয়, লুটপাট ও অনিয়মের এক অন্ধকার চিত্র, যা কেবল আর্থিক ক্ষতিই সৃষ্টি করেনি, বরং দেশের বিদ্যুৎ খাতের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতাকেও বিপন্ন করেছে।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির নামে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক, রাজনীতিক এবং আমলাদের মধ্যে একটি সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে উঠেছিল। এই চক্র সরকার কর্তৃক প্রণীত বিশেষ আইনের সুযোগ নিয়ে নিজেদের আর্থিক স্বার্থ হাসিল করেছে। এ আইনটির নাম ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, যা পরবর্তীতে ‘দায়মুক্তি আইন’ নামেও পরিচিতি পায়। এই আইনের অধীনে সরকার কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি অনুমোদন দিতে পারত। এই সুযোগেই দেশজুড়ে একের পর এক অনিয়মিত, অতিমূল্য ও অদক্ষ প্রকল্পের জন্ম হয়।
কমিটির তদন্তে দেখা গেছে, গত দেড় দশকে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে চার গুণ, কিন্তু এর বিপরীতে ব্যয় বেড়েছে ১১ গুণ। উৎপাদন বাড়লেও এর দক্ষতা কমেছে, আর খরচ বেড়েছে দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে। ২০১০-১১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে যেখানে ব্যয় হয়েছিল ৬৩৮ মিলিয়ন ডলার, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সেই ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭.৮ বিলিয়ন ডলারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপুল অর্থ কারা পাচ্ছে? জনগণের ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্র যে বিদ্যুৎ কিনছে, তার বিপরীতে প্রকৃত বিদ্যুৎ সরবরাহের হিসাব মেলানো যায় না। কমিটির মতে, এই অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ সংঘবদ্ধ দুর্নীতি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির বেশিরভাগই এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর ঝুঁকি একেবারেই না থাকে। এসব চুক্তি ছিল ‘ভাড়া নির্ভর’—অর্থাৎ বিদ্যুৎ সরবরাহ না করলেও সরকারকে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দিতে হতো কোম্পানিগুলোকে। এই অর্থের পরিমাণ এত বিশাল ছিল যে, তা কেবল বিদ্যুৎ না পেলেও ভাড়া বাবদ রাষ্ট্রের তহবিল থেকে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কাছে কোটি কোটি ডলার চলে গেছে। অনেক কোম্পানি প্রকৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই শুধু ভাড়ার অর্থ পেয়েছে, যার পেছনে ছিল রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক যোগসাজশ ও ক্ষমতার অপব্যবহার।
এই চুক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানি চুক্তিতেও একাধিক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ সরকার যে দামে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনছে, সেটি বাজারদরের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহের গ্যারান্টি, জ্বালানি পরিবহন খরচ, শুল্ক ও অন্যান্য শর্ত এমনভাবে নির্ধারিত হয়েছিল যাতে আদানির মুনাফা নিশ্চিত থাকে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কমিটির এক সদস্য আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, এই চুক্তি বাতিলের যথেষ্ট ভিত্তি রয়েছে, তবে আন্তর্জাতিক আইনি জটিলতার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করা সম্ভব নয়। কারণ, এটি একটি সার্বভৌম চুক্তি—একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য দেশের একটি কোম্পানির চুক্তি। এমন চুক্তি বাতিল করলে আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের দাবি উঠতে পারে, যার পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
কমিটির আহ্বায়ক বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। পুরো বিষয়টি কারিগরি, জটিল ও সংবেদনশীল। অনেক তথ্য এখনো সংগ্রহ করা হচ্ছে। জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে, যেখানে আরও বিস্তৃতভাবে দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হবে। কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে চুক্তির শর্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। কারো ব্যক্তিগত স্বার্থে সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনার ফল ভোগ করছে সাধারণ জনগণ, যাদের ঘাড়ে বিদ্যুতের বাড়তি দাম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুতের উচ্চমূল্যের কারণে প্রতিযোগিতা হারাচ্ছে। প্রতিবেদন বলছে, দুর্নীতির কারণেই বিদ্যুতের দাম প্রতিযোগীদের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি, আর ভর্তুকি বাদ দিলে তা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশের শিল্প খাত টিকবে না। এভাবে বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে থাকা অর্থনীতি ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ খাতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে, তা উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৪.৪ গুণ, অথচ ব্যয় বেড়েছে ১১ গুণ। এই বৈষম্যের কারণ শুধু প্রযুক্তিগত নয়, বরং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অনিয়মও এর পেছনে দায়ী। বিশেষ করে বিশেষ বিধান আইনের আওতায় যে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, সেটিই দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। কারণ, এই আইনের মাধ্যমে প্রকল্প অনুমোদন, টেন্ডার, মূল্য নির্ধারণ, এমনকি অর্থ ছাড় পর্যন্ত একদম নিরীক্ষাবিহীনভাবে করা যেত। ফলে সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মহল—সবাই এ খাত থেকে লাভবান হয়েছে।
কমিটির আরেক সদস্য শাহদীন মালিক বলেন, “আমরা যদি এখন চুক্তি বাতিল করি, তবে তারা আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে পারে। আর তাতে আমাদের ক্ষতি হতে পারে দশগুণ। তাই বুঝেশুনে পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে প্রমাণ পাওয়া গেলে চুক্তি বাতিলের পথ খোলা থাকবে।” অন্যদিকে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, “চুক্তিতে যদি কোনো দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে সরকার তা বাতিল করতে দ্বিধা করবে না। তবে আন্তর্জাতিক আইনে টিকে থাকার মতো প্রমাণ দিতে হবে।”
এই প্রতিবেদনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি শুধু অনিয়ম চিহ্নিত করেনি—বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্কবার্তাও দিয়েছে। কমিটির সদস্যরা মনে করেন, যদি বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির এই ধারা বন্ধ না করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই থাকবে না। কারণ, বিদ্যুৎ খাতই হলো শিল্পের প্রাণশক্তি। এই খাতের ব্যর্থতা মানে শিল্পখাতের ব্যর্থতা।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, দুর্নীতির দায় কেবল বেসরকারি কোম্পানি বা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নয়; প্রশাসনও এখানে দায় এড়াতে পারে না। বহু ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নীতিমালা পরিবর্তন করেছেন। আবার রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। এসব চুক্তির মাধ্যমে যে অর্থ দেশ থেকে বেরিয়ে গেছে, তা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আজ ভর্তুকি হিসেবে পরিশোধ করছে।
কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান আরও বলেন, “আমরা প্রমাণ সংগ্রহ করছি, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এইভাবে জনগণের অর্থ লুট করতে না পারে। এখন সময় এসেছে এসব চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের।” তিনি আরও যোগ করেন, “এই দুর্নীতি আমাদের রোধ করতেই হবে। কারণ, দুর্নীতির কারণে দেশের বিদ্যুতের দাম প্রতিযোগীদের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে গেছে। শিল্পকারখানাগুলো এই দামে টিকতে পারবে না। আমাদের এ চক্র ভাঙতেই হবে।”
সর্বশেষ, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, যারা এই দুর্নীতিতে জড়িত, তারা চাকরি ছেড়ে বা অবসর নিয়ে নিরাপদে আছেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, দুর্নীতির প্রমাণ মিললে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সরকারের নিজস্ব পর্যায়ে পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন, কারণ অনেকেই এখন আর সরকারি চাকরিতে নেই।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত একসময় দেশের উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু এই প্রতিবেদনের আলোকে তা এখন পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতীক হিসেবে। দুর্নীতি, অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা—সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাত এখন এক গভীর সংকটে। এই সংকট শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি নৈতিকতারও। জনগণের অর্থে নির্মিত একটি খাত যখন কিছু মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির উৎসে পরিণত হয়, তখন তা পুরো জাতির জন্য লজ্জার বিষয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই তদন্ত যদি কার্যকরভাবে শেষ হয় এবং এর সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়, তাহলে হয়তো বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতির এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। তবে যদি আবারও রাজনৈতিক প্রভাব বা প্রশাসনিক টানাপোড়েনে বিষয়টি ঝুলে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত ভবিষ্যতে আরও বড় সংকটে পড়বে। জনগণ হয়তো আবারও বিদ্যুতের দাম দিয়ে, ট্যাক্স দিয়ে, কিংবা শিল্পের পতন দেখে তার মূল্য দেবে। তাই এখনই সময়, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার—যাতে বিদ্যুৎ খাত কেবল উৎপাদনের নয়, জবাবদিহিরও প্রতীক হয়ে ওঠে।
আপনার মতামত জানানঃ