বাংলাদেশে নজরদারি সরঞ্জাম আমদানির ইতিহাস তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও এর প্রভাব ও পরিসর দ্রুত বিস্তৃত হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো—পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)—গত এক দশকে যেসব উন্নতমানের সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স (SIGINT) ও ইলেকট্রনিক নজরদারি প্রযুক্তি সংগ্রহ করেছে, তা শুধু অপরাধ দমনে নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা সরকারি নথিপত্রে দেখা যায়, অন্তত ২০টি দেশের ২৩টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এই সরঞ্জাম আনা হয়েছে। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে কয়েকটি দেশের প্রযুক্তি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার উদ্বেগের কারণে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের আওতায় ছিল। তবুও এসব সরঞ্জাম তৃতীয় দেশের মাধ্যমে বা মধ্যস্বত্বভোগী সরবরাহকারীর সহায়তায় বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
নজরদারি সরঞ্জাম সংগ্রহের সূচনা হয় ২০১৬ সালে। সেই বছর র্যাব বুলগেরিয়ার সামেল নাইনটি নামের প্রতিষ্ঠান থেকে একটি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার আমদানি করে। এই যন্ত্র নির্দিষ্ট এলাকায় মোবাইল ফোন, জিপিএস বা ওয়াইফাই সিগন্যাল ব্যাহত করতে সক্ষম, যা বড় জনসমাবেশ বা বিশেষ অভিযানে ব্যবহার হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ—এ ধরনের জ্যামার রাজনৈতিক সমাবেশে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ব্যবহৃত হয়েছে, বিশেষ করে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে।
২০১৭ সালে র্যাব একটি যানবাহনে স্থাপনযোগ্য নেটওয়ার্ক জ্যামার কিনে, যা চলমান অবস্থায়ও আশপাশের সিগন্যাল বন্ধ করতে পারে। একই সময়ে পুলিশও নজরদারি সরঞ্জাম সংগ্রহে প্রবেশ করে, যার মধ্যে ছিল আইএমএসআই ক্যাচার—যন্ত্রটি নিকটবর্তী মোবাইল ফোনের সিগন্যাল ধরে ব্যবহারকারীর পরিচয়, অবস্থান ও কল ডেটা সংগ্রহ করতে পারে। পরবর্তী সময়ে সংস্থাগুলো ম্যান-ইন-দ্য-মিডল (MITM) সিস্টেম যুক্ত করে, যা দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করে কল শোনা, বার্তা পড়া এবং নেটওয়ার্কে প্রবেশের সুযোগ দেয়।
এই প্রযুক্তির তালিকায় আরও যুক্ত হয় স্যাটকম অ্যানালাইজার—যা স্যাটেলাইট যোগাযোগের সিগন্যাল শনাক্ত, বিশ্লেষণ ও জ্যাম করতে পারে—এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ডিভাইস, যা সীমান্ত বা দুর্গম এলাকায় গোয়েন্দা কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং সিস্টেম, ড্রোন সিগন্যাল জ্যামার এবং আন্তর্জাতিক ফোন কল মনিটরিং প্রযুক্তিও সংগ্রহ করা হয়।
সরবরাহকারীদের মধ্যে ছিল জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ আরও কয়েকটি দেশ। কিছু সরঞ্জাম এসেছে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য ভিন্ন দেশে নিবন্ধিত ‘শেল কোম্পানি’র মাধ্যমে। যেমন—ইসরায়েলি প্রযুক্তি সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি কোম্পানির নামে বাংলাদেশে এসেছে বলে নথিতে উল্লেখ রয়েছে।
সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়াও অনেক সময় ছিল অস্বচ্ছ। অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুমতিতে সরাসরি দরপত্র আহ্বান করে ক্রয় সম্পন্ন হয়েছে, যাতে সাধারণ বাণিজ্যিক আমদানির নিয়ম প্রযোজ্য হয়নি। অর্থায়ন এসেছে উন্নয়ন বাজেট, বিশেষ প্রকল্প তহবিল বা বিদেশি সহায়তা থেকে।
এসব প্রযুক্তি অপরাধ দমনে কার্যকর হলেও মানবাধিকার নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অধিকাংশ নজরদারি সিস্টেম এমনভাবে নকশা করা যে, তা টার্গেট ছাড়া অন্যদেরও তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করেছে—এই ক্ষমতা রাজনৈতিক বিরোধী, সাংবাদিক বা আন্দোলনকর্মীদের পর্যবেক্ষণে ব্যবহার হতে পারে। বাংলাদেশে কিছু সাংবাদিক এবং বিরোধী দলীয় নেতা অভিযোগ করেছেন, তাদের ফোন কল নজরদারির আওতায় নেওয়া হয়েছে এবং চলাফেরার পথ অনুসরণ করা হয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তারা অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, প্রযুক্তি শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদ, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও সংঘবদ্ধ অপরাধ মোকাবিলায় ব্যবহার হচ্ছে। তবে নাগরিক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ভারসাম্য বজায় রাখা নিয়ে বিতর্ক থামেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, নজরদারি প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়বে, তত বেশি প্রয়োজন হবে আইনগত সুরক্ষা ও স্বচ্ছ তদারকির।
আপনার মতামত জানানঃ