বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসি থেকে দুটি আধুনিক বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে, যার ব্যয় হবে প্রায় ৯৩৬ কোটি টাকা বা ৭ কোটি ৬৬ লাখ মার্কিন ডলার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেখানে উল্লেখ করা হয় যে দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি কাজ পেয়েছে। জাহাজ দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে কেনা হবে। সরকারি সূত্র জানায়, এই জাহাজগুলো দেশের নৌপরিবহন সক্ষমতা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনে স্বনির্ভরতা, এবং সামুদ্রিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তবে এই ক্রয়কে ঘিরে কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়েও আলোচনা চলছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী বাণিজ্য ও রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সম্পর্ক বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস এর আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সক্রিয় ছিলেন। ২০২৫ সালের শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানিতে ৩৭% শুল্ক আরোপ করলে ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্পকে চিঠি লিখে এই শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগে তিন মাস সময় চান। এর পরপরই ট্রাম্প শুল্ক কমিয়ে ২০%-এ নামিয়ে আনেন, যা ইউনূস “ঐতিহাসিক কূটনৈতিক সাফল্য” বলে আখ্যা দেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানির প্রতিশ্রুতিসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক সমঝোতাও এই সময়ে সম্পন্ন হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের বৃহৎ ক্রয়চুক্তি একদিকে বাংলাদেশের নৌপরিবহন খাতের আধুনিকীকরণে সহায়ক, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক আরও মজবুত করার কৌশল হিসেবেও কাজ করতে পারে। বিশেষ করে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে যেখানে বাণিজ্যনীতি ও কূটনীতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে, সেখানে বড় আকারের আমদানি চুক্তি শুধু অর্থনৈতিক প্রয়োজন নয়, বরং কূটনৈতিক বার্তাও বহন করে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সদ্য ঘটে যাওয়া শুল্কসংক্রান্ত সমঝোতার পর এমন একটি চুক্তি ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আস্থার বার্তা পাঠানো এবং সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
ফলে, এই জাহাজ কেনার বিষয়টিকে একমাত্র অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হলে এটি দেশের জন্য বড় অর্জন হতে পারে, কারণ এতে নৌপথে দেশের পণ্য পরিবহন খরচ কমবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে। কিন্তু কূটনৈতিক বাস্তবতায় এর পেছনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কৌশলগত হিসাব-নিকাশও রয়েছে—যা একসাথে দেশের স্বার্থ রক্ষা এবং প্রভাবশালী বিশ্বশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার দ্বিমুখী লক্ষ্যকে সামনে রাখে।
আপনার মতামত জানানঃ